-
আজকের প্রসঙ্গ শসা
প্রথমেই এর পুষ্টি নিয়ে না বললেই নয়। শসা ভিটামিন এবং মিনারেলেস পরিপূর্ণ একটি সবজি। এর ৯৬ শতাংশ পানি। শসা ভিটামিন-কে, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-এ, ফলিক এসিড, পটাশিয়াম এবং ম্যাঙ্গানিজের উত্তম উৎস। এ ছাড়া রিবোফ্লাবিন, প্যান্টোথেনিক এসিড, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, সালফার, সিলিকা এবং ভিটামিন বি-৬ আছে বেশি পরিমাণে। শসা থেকে খাদ্য আঁশ পাওয়া যায়। তবে এতে স্যাচুরেটেড ফ্যাট আর কোলেস্টরলের পরিমাণ খুব কম বলে এটি প্রায় সব ধরনের মানুষের জন্যই দারুণ উপকারী। এতে আরো রয়েছে ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস, কিউকারবিটাকিন্স, লিগনান্স এবং ফ্লাভনয়েডস। এ ছাড়া কম কোলেস্টরল ও কম ফ্যাট-যুক্ত শসা থেকে বাড়তি ক্যালোরি পাওয়া যায় বলে যারা ওজন কমাতে বা দীর্ঘদিন আদর্শ ওজন ধরে রাখতে চান তাদের জন্য শসা সব সময়ই আদর্শ একটি খাদ্য হিসেবে বিবেচিত। এতে কোনো সম্পৃক্ত চর্বি বা কোলেস্টেরল নেই।
এবার আসি স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়ে:
-
এক
হাইড্রেট করে অথবা পানিশূন্যতা দূর করে:
শশা সবচেয়ে হাইড্রেটিং খাবারগুলির মধ্যে একটি। দেহের পানিশূন্যতা দূর করতে সাহায্য করে এটি।ধরুন আপনি এমন কোথাও আছেন, যেখানে হাতের কাছে পানি নেই, কিন্তু শসা আছে।বড়সড় একটা শসা চিবিয়ে খেয়ে নিন। পিপাসা মিটে যাবে।আপনি হয়ে উঠবেন চনমনে।কারণ, শসার ৯০ শতাংশই পানি এবং এগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ ইলেক্ট্রোলাইট থাকে।তারা গরম আবহাওয়াতে বা কোনও ওয়ার্কআউটের পরে ডিহাইড্রেশন রোধ করতে সহায়তা করতে পারে।
স্বাস্থ্যকর অন্ত্র বজায় রাখতে, কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করতে, কিডনিতে পাথর এড়ানো এবং আরও অনেক কিছুর জন্য হাইড্রেটেড থাকা জরুরি। আবার কখনও কখনও আপনি শরীরের ভেতরে-বাইরে প্রচণ্ড উত্তাপ অনুভব করেন।দেহে জ্বালাপোড়া শুরু হয়।এ অবস্থায় একটি শসা খেয়ে নিন, আরাম পাবেন।
-
দুই
হাড়ের স্বাস্থ্য:
ভিটামিন কে রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে এবং এটি হাড়ের স্বাস্থ্যের পক্ষে সহায়তা করতে পারে।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) অনুযায়ী, ১৪২ গ্রাম শসাতে ১০.২ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে রয়েছে।
আমেরিকান ডায়েটারি গাইডলাইন ২০১৫-২০২০ ভিটামিন কে নেয়ার প্রস্তাবনা দেয় এইভাবে-
১৯ বছর বা তার বেশি বয়সের মহিলাদের জন্য প্রতিদিন ৯০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে গ্রহণ করতে হবে ও একই বয়সের পুরুষদের জন্য ১২০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে গ্রহণ আবশ্যক।সেক্ষেত্রে শসার কিন্তু কোনো বিকল্প নেই।
প্রাপ্তবয়স্কদের লিঙ্গ এবং বয়সের উপর নির্ভর করে দিনে এক হাজার-১,২০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন।শসায় ক্যালসিয়ামও রয়েছে।গুরুত্বপূর্ন বিষয় হচ্ছে ভিটামিন কে ক্যালসিয়াম শোষণকে উন্নত করতে সহায়তা করে।তাই বোঝার বাকি থাকেনা,শসা হচ্ছে একটি পাওয়ার প্যাকেজ যা হাঁড় সুরক্ষায় সাহায্য করতে সক্ষম।
-
তিন
ক্যান্সার:
শসাতে রয়েছে cucurbitacin যা তিক্ত স্বাদযুক্ত ও উচ্চ পুষ্টিযুক্ত। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ হেলথ সার্ভিসেস-এর একটি নিবন্ধ অনুসারে, cucurbitacin ক্যান্সার কোষগুলিকে প্রজনন বন্ধ করে ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে।এছাড়াও এর ত্বক সহ ১৩৩গ্রাম শসা প্রায় ১ গ্রাম ফাইবার সরবরাহ করে।ফাইবার কলোরেক্টাল ক্যান্সার থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করতে পারে।
-
চার
হৃদযন্ত্রের সুস্থতা:
শসাতে আছে ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম এবং ভিটামিন কে। এই তিনটি উপাদান হৃদযন্ত্রের সুস্থতা রক্ষা করতে সাহায্য করে। ম্যাগনেসিয়াম ও পটাসিয়াম গ্রহণের মাধ্যমে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। নিয়মিত শসা খাওয়া কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায় এবং শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখে।আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের ভাষ্যমতে ফাইবার কোলেস্টেরল পরিচালনা এবং কার্ডিওভাসকুলার সম্পর্কিত সমস্যা রোধে সহায়তা করে।
-
পাঁচ
ডায়াবেটিস:
শসা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে। এটিতে এমন পদার্থ রয়েছে যা রক্তে শর্করাকে হ্রাস করতে বা রক্তের গ্লুকোজকে অত্যধিক উচ্চতা বৃদ্ধি থেকে বিরত করতে সহায়তা করে।পানিতে সমৃদ্ধ হওয়ায় তারা আপনার পেটে প্রসারিত হয় ফলে মিষ্টি নাস্তার জন্য আকাঙ্ক্ষাকে হ্রাস করে, যা ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার একটি দুর্দান্ত উপায়।
-
ছয়
স্মৃতি বৃদ্ধি ও ব্যথার উপশম:
সম্প্রতি, বিজ্ঞানীরা ফ্ল্যাভোনয়েড ফিসেটিন সম্পর্কে আগ্রহী হয়েছেন।শসা ফিশেটিনের একটি ভাল উৎস যা গবেষণায় স্নায়ু কোষ রক্ষা, স্মৃতিশক্তি উন্নত করতে এবং আলঝাইমার ঝুঁকি হ্রাস করার সাথে যুক্ত রয়েছে।একই পর্যালোচনাতে ফিসেটিন ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে পারে এমন আশাজনক ফলাফল পাওয়া গেছে।এছাড়াও ফ্ল্যাভোনয়েড শরীরের বিষাক্ত ফ্রি রেডিক্যাল এর মাত্রা কমিয়ে নানা ধরনের ব্যথার উপশম ঘটায়।
-
সাত
কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করুন:
এরেপসিন নামক অ্যানজাইম থাকার কারণে শসা হজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা সমাধান করে থাকে।এছাড়াও এতে প্রচুর পরিমাণে পানি থাকে এবং তাদের ত্বকে অদৃশ্য ফাইবার থাকে।পানি এবং ফাইবার উভয়ই খাদ্য পরিপাকতন্ত্রের মধ্য দিয়ে দ্রুত এবং আরও সহজেই যেতে সাহায্য করে, কোষ্ঠকাঠিন্য রোধে সহায়তা করে।শসার রস আলসার, গ্যাস্ট্রাইটিস, অ্যাসিডিটির ক্ষেত্রেও উপকারী।
-
আট
স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখে:
শসাতে খুব কম ক্যালোরি থাকে ও এদের ত্বকে ফাইবারও থাকে।ফাইবারযুক্ত খাবার স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে সহায়তা করে।
-
নয়
ত্বকের পরিচর্যায় উপকারী:
শসাতে সিলিকা নামক একটি উপাদান রয়েছে, যা শরীরে প্রবেশ করার পর কোষের কর্মক্ষমতাকে বাড়িতে তোলে।ফলে ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি তো পায় সেই সঙ্গে শরীরের প্রতিটি পেশী, লিগামেন্ট এবং হাড়ের শক্তিও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।এখানেই শেষ নয়, শসা খাওয়া শুরু করলে দেহের ভেতরে পানির পরিমাণ বাড়তে শুরু করে যার প্রভাবে ত্বকের ভিতরে জমে থাকা টক্সিক উপাদান বেরিয়ে য়ায়। এর ফলে ত্বকের বয়স কমতে শুরু করে।এভাবে একটি শসা কিন্তু জয়া আহসানের মতো অল্প বয়সী লুক এনে দিতে পারে!
-
দশ
মানসিক চাপ কমায়:
শসা ভিটামিনে ভরপুর, বিশেষ করে ভিটামিন বি১, বি৫ ও বি৭ রয়েছে এতে। এ ভিটামিনগুলো সমন্বিতভাবে স্নায়ুকে শিথিল করে এবং মানসিক চাপের জন্য হওয়া উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে।
-
এগার
দুর্গন্ধ কমায়:
আয়ুর্বেদের নীতিমালা অনুসারে শসা সেবন পেটে অতিরিক্ত উত্তাপ নিঃসরণে সহায়তা করে যা দুর্গন্ধ রোধে প্রাথমিক কারণ। আপনার মুখে এক স্লাইস শসার টুকরো রোগজনিত ব্যাকটেরিয়া থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করে।
কোনো কিছু যে অতিরিক্ত ভালো না,মুরব্বীরা বলেন তাই না?ডায়েট মানেই রাত দিন শসা এ ধারণাটি ভুল।কেনো ভুল চলুন তা জেনে নেই-
অতিরিক্ত ভিটামিন সি এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
ভিটামিন সি একটি প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর উপাদান। এছাড়াও, এটি ফ্লু এবং স্কার্ভি সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যের অবস্থার প্রতিরোধ ও লড়াইয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এটি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টও।তবুও, প্রস্তাবিত সীমা অতিক্রম করা কোনো ক্ষেত্রেই ঠিক নয়।শসা বেশি খলে ভিটামিন সি ও প্রচুর পরিমাণে খাওয়া হয়, তখন এটি সহজাত অ্যান্টি-অক্সিডেটিভ প্রকৃতির বিরুদ্ধে প্রো-অক্সিডেন্টের মতো কাজ করে।আর তখন ফ্রি রেডিকেলের বিরুদ্ধে ভিটামিন সি এর কার্যক্ষমতার ঘাটতি ঘটে এবং ফলাফল আপনি ক্যান্সার, ব্রণ, অকাল বয়সের ঝুঁকিতে পড়বেন।যদিও ভিটামিন সি পানিতে দ্রবণীয় এবং অতিরিক্ত ভিটামিন সি প্রস্রাবের সাথে শরীর থেকে বেরিয়ে যায় তবে ঘন ঘন প্রস্রাব করা আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেই ভাল না এবং এজনয ভিটামিন সি গ্রহণের সীমাবদ্ধতায় রাখা শ্রেয়।
-
ক
কিডনীর জন্য ক্ষতিকর:
অতিরিক্ত পটাশিয়াম কিডনীর উপর চাপ ফেলে ।শসার পানির একটি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হল এটি আপনার কিডনির পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। শসা থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি রক্তনালীএবং হার্টের উপর চাপ সৃষ্টি করে যা কিডনির সিস্টেমকে ভারসাম্যহীনতার দিকে নিয়ে যায়।
-
খ
বিষক্রিয়া হতে পারে:
যদিও শসা একটি স্বাস্থ্যকর ফল তবে এটিতে ছোট ছোট প্যাচ থাকে যা এর স্বাদ তিক্ত করে তোলে।শসার এই ক্ষুদ্র অংশে অত্যন্ত বিষাক্ত ট্রাইটারপেইনয়েডস বা কিউকিউরবিটাসিন যৌগ থাকে। সুতরাং এটি গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা আমাদের শসা খাওয়া সীমাবদ্ধতার মধ্যে রেখেছি।অতিরিক্ত খেলে বিষক্রিয়া হতেই পারে!
এছাড়াও অনেকের ক্ষেত্রে চুলকানি, মুখ বা মুখ ফোলাভাব, গলা সংক্রমণ ইত্যাদির মতো প্রতিক্রিয়ার ঘটেছে।তাছাড়া যাদের ঠান্ডার সমস্যা তাদের সাইনোসাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কী বুঝলেন?এর মানে দাঁড়ায় অতিরিক্ত শসা খাওয়া যাবেনা।
সবশেষে কিছু টিপস না দিলে তো হচ্ছে না-
-
এক
সকালে খালি পেটে শসা খাবেন না
-
দুই
এসিডিটি থাকলে শসার বিচি ফেলে খাবেন।
-
তিন
বেশি রাতে শসা না খাওয়া উত্তম
-
চার
কাঁচা শসা বেশি উপকারি তাই রান্নার চেয়ে কাঁচাটাই গ্রহণ করবেন ।
-
পাঁচ
অন্যান্য সবজির সঙ্গে সালাদ খাওয়া উত্তম।
-
ছয়
ওজন কমাতে টকদইয়ের সঙ্গে শসার টুকরো মিশিয়ে খেতে পারেন।
শসা নিয়ে নিশ্চয়ই আজ অনেক কিছু জানতে পারলেন।শসা ডায়েটে রাখুন কিন্তু তা যেনো আবার অতিরিক্ত না হয় খেয়াল রাখবেন।ভালো থাকুন,সুস্থ থাকুন ।
ধন্যবাদ
Dietitian Shirajam Munira
কনসালটেন্ট
ইবনেসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ও
কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
Dietitian Shirajam Munira |
আপনি জানেন কী শসা মানবদেহের জন্য কতটা দরকারি ? |
সুখাদ্য |
- royalbangla.com এ আপনার লেখা বা মতামত বা পরামর্শ পাঠাতে পারেন এই এ্যড্রেসে [email protected]
পরবর্তী পোস্ট |
ইউরিন ইনফেকশন: কারণ ও প্রতিরোধের উপায় |