মানুষের দুধ খাওয়ার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হাজার হাজার বছর আগে মানুষের পরিপাকতন্ত্রে অন্য কোন প্রাণীর দুধ হজমকারী কোন এনজাইম ছিল না। মানে দুধে কার্বোহাইড্রেট ল্যাক্টোজ হজমকারী ল্যাকটেজ এনজাইম মানুষের পরিপাকতন্ত্রে ছিল না। তাই মানুষ দুধ খেয়ে হজম করতে পারত না। কিন্তু বিবর্তনের ফলে মানুষের পরিপাকতন্ত্রে ল্যাকটেজ এনজাইম তৈরী হতে শুরু করে। গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া এখন সকলের পরিপাকতন্ত্রে ল্যাকটেজ এনজাইমের উপস্থিতি আছে। তাই মানুষ এখন দুধ খেয়ে হজম করতে পারে।
দুধের উপাদানঃ
দুধকে বলা হয় আদর্শ সুষম খাবার। এখানে আমাদের শরীরের চাহিদা অনুযায়ী প্রায় সকল উপাদান নির্দিষ্ট অনুপাতে আছে। পৃথিবীতে দুধই একমাত্র খাবার, যেটা খেয়ে মানুষ জীবনধারণ করতে পারে। দুধে ভিটামিন সি ছাড়া প্রায় সকল উপাদানই বিদ্যমান। সবধরনের এসেনশিয়াল এমাইনো এসিড, ভিটামিন, খনিজ যেমন ক্যালশিয়াম, জিংক, কোবাল্ট, ফসফরাস বিদ্যমান। দুধের প্রধান উপাদানগুলো...
১) পানি ৮৬.৫%
২) কার্বোহাইড্রেট ৪.৮%
৩) প্রোটিন ৩.৫%
৪) ফ্যাট ৪.৫%
৫) আয়রন-০.১ মিলিগ্রাম
৬) ফাইবার-০.১ গ্রাম
৭) ক্যালসিয়াম-১২৫ মিলিগ্রাম
৮) সোডিয়াম-০.৭৭ গ্রাম
৯) জিংক - ০.৪ মিলিগ্রাম
তবে গরুর প্রজাতি এবং খাদ্যাভ্যাসভেদে উপাদানের পরিমান কমবেশি হতে পারে।
দুধ পানের উপকারিতাঃ
১) দুধের ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি হাড় ও দাঁতের ক্ষয়রোধ করে এবং সুরক্ষা প্রদান করে।
২) ভিটামিন ও মিনারেলস মানসিক চাপ কমিয়ে শারীরিক ফিটনেস বাড়ায়। রাতে ঘুমানোর আগে একটু কুসুম গরম দুধ খেলে ভালো ঘুম হয়।
৩) পিরিয়ডের ব্যাথা, সারাদিনের কর্মক্লান্তি দুর করতে কুসুম গরম দুধ খুব উপকারী।
৪) লো-ফ্যাট দুধ রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
৫) দুধের যেহেতু ৮৬% ই পানি, তাই এটি শরীরকে পানিশূন্যতা থেকে মুক্ত রাখে।
৬) শিশুরা প্রতিদিন দুধ পান করলে শিশুদের মস্তিষ্কের এবং পেশির গঠন ভালো হয়।
৭) ইমিউন সিস্টেম বৃদ্ধি করে, ফলে শরীর সহজে রোগাক্রান্ত হয় না।
৮) ত্বক এবং চুলের যত্নে দুধ খুব গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করে। নিয়মিত দুধ খেলে ত্বক নরম, কোমল ও মসৃণ হয়।
৯) দুধের গ্লাই সিমিক ইনডেক্স অনেক কম, তাই এটি ডায়াবেটিক ব্যাক্তিদের জন্যও খুব উপকারী পানীয়। দুধ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রন করে।
১০) গ্লাইসিমিক ইনডেক্স কম হওয়ার কারনে দুধ ওজন কমাতেও সাহায্য করে।
দুধ পান জনিত সমস্যা ও সমাধানঃ
যদিও দুধকে সুপার ফুড বলা হয়, তবুও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুধ পানজনিত কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে।
১) হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা ফুলক্রিম দুধ খেলে জটিলতা বাড়ে। সেক্ষেত্রে উনারা সর ছাড়া দুধ খাবেন।
২) যাদের ল্যাক্টোজ ইনটলারেন্স আছে, উনারা দুধ খাবেন না। উনারা দুধ খেলে পেটব্যাথাসহ পাতলা পায়খানা হতে পারে। তবে দুধের পরিবর্তে টকদই খেলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
৩) ডায়াবেটিক ব্যাক্তিদেরও ফুলক্রিম দুধ খাওয়া যাবে না। এতে ডায়াবেটিস বেড়ে যেতে পারে। তাই উনারাও লো-ফ্যাট দুধ খাবেন।
৪) যাদের আইবিএস এর সমস্যা আছে তারা দুধ খাবেন না। দুধ খেলে পাতলা পায়খানাসহ পেট ব্যাথা হতে পারে। সেক্ষেত্রে দুধের পরিবর্তে টকদই খেলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
৫) যাদের উচ্চরক্তচাপ আছে, তারা কম পরিমানে সর ছাড়া দুধ খাবেন।
কাঁচা দুধ কি স্বাস্থ্যকর?
অনেকে না বুঝেই কাঁচা দুধ খেয়ে থাকেন। এটা থেকে আমাদের বিরত থাকা উচিৎ। কারন আমাদের দেশের বেশিরভাগ দুধের খামারে দুধ দোহন পদ্ধতি শতভাগ স্বাস্থ্যসম্মত নয়। সেক্ষেত্রে দুধ দোহনের সময় কিছু অপদ্রব্য এবং জীবানু দুধের সাথে মিশে যেতে পারে। তাই দুধ কোনভাবেই না ফুটিয়ে খাওয়া উচিৎ নয়। এতে স্বাস্থ্য ঝুকি তৈরী হতে পারে।
দুধ কখন খাবেনঃ
দুধ যেহেতু একটি আদর্শ খাবার, তাই এটি যেকোন সময়ে খাওয়া যায়। আমরা সাধারণত রাতের খাবারের পরে, ঘুমানোর আগে দুধ খেতে অভ্যস্ত। এটা খুব ভালো অভ্যাস। তবে ডায়াবেটিক ব্যাক্তিরা বিকালে দুধ খাবেন। রাতে দুধ খেলে ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে আপনি একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিয়ে, রাতের খাবারের পরিমান ব্যালান্স করে নিয়ে রাতে দুধ খেতে পারেন। হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের জন্যও একই পরামর্শ থাকবে।
বাচ্চাদের কত বছর বয়সে গরুর দুধ দেওয়া যাবেঃ
এটি সকল মায়েদের জিজ্ঞাসা যে, আমার বাচ্চাকে কতমাস বয়সে গরুর দুধ দেওয়া যাবে। আপনি আপনার বাচ্চার বয়স ১৮ মাস হলেই তাকে গরুর দুধ খাওয়াতে পারবেন। তার আগে দিবেন না। কারন গরুর দুধে সোডিয়ামসহ কিছু উপাদান একটু বেশি পরিমানে থাকে। যেগুলো ছোট্ট শিশুর কিডনিসহ অন্যান্য অর্গানের জন্য হুমকি হতে পারে।
আপনি যখন আপনার শিশুকে প্রথমবার গরুর দুধ খাওয়াবেন, তখন তাকে খুব ভালো করে অবজার্ভেসনে রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যে, দুধ খেয়ে তার পাতলা পায়খানা, পেটব্যাথা, শরীরে এলার্জি, র্যআশ এগুলো হচ্ছে কিনা। যদি হয় তাহলে পরবর্তিতে আর দুধ দিবেন না এবং একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।
দুধ পানের খুব সামান্য কিছু জটিলতা থাকলেও এর উপকারীতা অনেক অনেক বেশি। তাই আসুন, সুস্থ থাকতে আমরা(পূর্ণবয়স্ক ব্যাক্তি) প্রতিদিন অন্তত ২৫০মিঃলিঃ দুধ পান করি।
এই লেখকের সব লেখা পড়ুন নিচের লিংক থেকে।
www.royalbangla.com/Nutritionist.Iqbal
লেখক
পুষ্টিবিদ মোঃ ইকবাল হোসেন
বিএসসি (সম্মান), এমএসসি (প্রথম শ্রেণী) (ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি)
পুষ্টি কর্মকর্তা
চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল।
চেম্বারঃ১
সার্জিস্কোপ হাসপাতাল
ইউনিট-২
কাতালগঞ্জ, চকবাজার মোড়,
চট্টগ্রাম।
চেম্বারঃ২
হাটহাজারী ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার
ফায়ার সার্ভিসের পশ্চিম পাশে
হাটহাজারী পৌরসভা
হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে নিচের ফেসবুক পেইজে ক্লিক করুন
www.facebook.com/Nutritionist.Iqbal