ডায়েট নিয়ে বেশ একটা উন্মাদনা চলছে এখন। এটা খুবই ভালো দিক, বিশেষ করে চারদিকে যখন রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব; ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাই কোলেস্টেরল যখন মহামারি, অল্প বয়সী লোকজন যখন হার্টএটাক, স্ট্রোক করে টপাটপ মৃত্যু বরণ করছে নয়তো পঙ্গুত্ব, তখন লোকজন স্বাস্থ্যসচেতন হচ্ছে, ডায়েট করছে, মেদভুড়ি ঝরিয়ে ফেলছে এটা খুবই ভালো লক্ষণ।
বিশ্বব্যাপী অনেক ধরনের ডায়েট প্রচলিত আছে- কিটো ডায়েট, মেডিটারিয়ান ডায়েট, ড্যাশ ডায়েট, ভেজিটেরিয়ান ডায়েট, ওয়াটার বেসড ডায়েট, ক্যালরি ডেফিসিট ডায়েট ইত্যাদি। এরমধ্যে কিটো ডায়েট নিয়ে খুব উন্মাদনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে ইদানিং। কিটো ডায়েটে খুব দ্রুত রেজাল্ট পাওয়া যায়, ৮ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ৫-১০ কেজি পর্যন্ত ওয়েট লস করছে মানুষজন। এতো দ্রুত হাতেনাতে এরকম ফলাফলের কারণে এই ডায়েটের দিকে ঝুঁকছে মানুষজন। কিন্তু এই কিটো ডায়েটের রয়েছে অনেক নেগেটিভ দিক। না জেনে না বুঝে প্রোপার ওয়েতে না করলে ডায়াবেটিস, কার্ডিয়াক এ্যারেষ্টসহ মৃত্যুর সম্ভাবনাও রয়েছে এই ডায়েটে।
প্রথমেই জেনে নেই কিটো ডায়েট কি? আমাদের শরীর হাটাচলাসহ নিত্যদিনের যে কর্মকাণ্ড চালায় তার শক্তির উৎস মূলত ক্যালরী। এই ক্যালরীর মূল সোর্স হলো কার্বোহাইড্রেট। প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট নিলে সেটাই জমে চর্বিতে পরিণত হয়, যেটা মেদভুড়ি হিসেবে প্রকাশ পায়। এই চর্বিটা শরীর এমারজেন্সি অবস্থার জন্য জমিয়ে রাখে। ধরুণ আল্লাহ না করুক আপনি কোন কন্টেইনারে আটকা পড়লেন বা বিল্ডিং ধ্বসে রানা প্লাজার ওই মেয়েটার মতো আটকা পড়লেন বা সমুদ্রে জাহাজ ডুবে ৫-৬ দিন পানিতে ভাসতে থাকলেন; এই সময়তো কোন খাবার-দাবার নেই, শরীর তখন এমারজেন্সি ঘোষণা করে। শরীরের জমে থাকা যে চর্বি থাকে সেটাকেই ভেঙ্গে ভেঙ্গে শরীরে বেচে থাকার রসদ যোগাতে থাকে। একারণেই দেখবেন এইরকম ঘটনায় সারভাইভারদের শরীর একদম রোগাপটকা হয়ে যায়, শরীরে চর্বির কোন লেশমাত্র থাকে না। থাকবে কিভাবে শরীর তো চর্বি ভেঙ্গে এইকয়দিন বেচে থাকার রসদ যুগিয়েছে।কিটো ডায়েট হলো শরীরকে কার্বোহাইড্রেটের যোগান না দিয়ে সুস্থ্য অবস্থায়ই শরীরকে এরকম এমারজেন্সি স্টেটে নিয়ে যাওয়া, যে অবস্থায় শরীর কার্বোহাইড্রেটের পরিবর্তে শরীরের জমে থাকা চর্বি থেকে শক্তি সঞ্চয় করবে, ফলশ্রুতিতে খুব দ্রুত আপনি মেদভুড়ি থেকে রেহাই পাবেন। শরীরকে প্রচুর ফ্যাট দিয়ে শরীরকে বলা এখন থেকে তুমি এনার্জি নিবা ফ্যাট থেকে, কার্বোহাইড্রেট থেকে নয়।
কিটো ডায়েটের উৎপত্তি কিন্তু রোগের চিকিৎসা হিসেবে ১৯২০ সালের দিকে ৷ এপিলেপ্সি বা মৃগী রোগীদের উপর এই ডায়েট এপ্লাই করে চমকপ্রদ ফলাফল পাওয়া যায়। পরবর্তীতে দ্রুত ওয়েট লস করার জন্য কিছু হেলথ প্রাকটিশনার এই ডায়েট রেকমেন্ড করা শুরু করেন।
এই ডায়েটের কিছু নেগেটিভ দিক তুলে ধরছিঃ
১
প্রথমত আপনি যে কিটো স্টেটে আছেন এটা কিন্তু নিশ্চিত না। আপনি হয়তো ভাবছেন আপনি কিটো স্টেটে আছেন কিন্তু শরীর আসলে কিটোন নিঃসরণ করছে না। এটা বোঝার জন্য কিটোস্টিক পাওয়া যায় প্রেগনেন্সি স্ট্রিপের মতো। এটাতে ইউরিন টেষ্ট করলে বুঝতে পারবেন আসলেই শরীর কিটোন ছাড়ছে কিনা। ব্লাড টেষ্ট করেও বোঝা যায়, এবং এটাই উত্তম পদ্ধতি।
২
যে জিনিস দ্রুত অর্জন হয়, সেটা হারাতেও হয় দ্রুত। কিটোতে ওয়েট লস হয় দ্রুত, কিন্তু ছেড়ে দিলে ওয়েট গেইন করাও শুরু হয় জ্যামিতিক হারে।
৩
কিটো স্টেট হলো শরীরের একটা এমারজেন্সি অবস্থা। চরম বিপদে পড়লে শরীর এই অবস্থায় যেয়ে শরীরকে বেচে থাকার রসদ যোগায়। আপনি সুস্থ্য স্বাভাবিক অবস্থায়ই শরীরকে এরকম জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বারবার৷ এটা কতটুকু ভালো এবং নিরাপদ, নিজের বিবেককেই প্রশ্ন করুন।
৪
কিটো ডায়েটের উৎপত্তি হয়েছিলো নির্দিষ্ট কিছু রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে ডাক্তারদের স্ট্রিক্ট সুপারভিশনে। আপনি দুইটা ইউটিউব ভিডিও দেখে যার তার পরামর্শে কোন সুপারভিশন ছাড়া শরীরকে এমন জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে নিয়ে গেলেন, ব্যাপারটা কতটুকু বুদ্ধিমানের কাজ হলো?!?
৫
কিটো স্টেটে যাওয়ার যেমন প্রসিডিওর আছে তেমনি বের হবারও প্রসিডিওর আছে। একমাস কিটোতে থাকার পর হুট করে একদিন বন্ধুদের খপ্পরে পড়ে কাচ্চি মেরে দিলেন, বা বার্গার খেলেন বা ভাত, শরীর কিন্তু হুট করে আবার নর্মাল স্টেটে চলে যাবে এবং ফলাফল গুলো আগেই বলেছি- র্যাপিড ওয়েট গেইন করা শুরু করবেন, খুব বড় হেলথ হ্যাজার্ড হতে পারে, সেটা হার্টএটাক থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত। কাজেই খুব খিয়াল কইরা!
৬
আমরা সবকিছুতেই শর্টকাট খুজি। ফিট থাকার মধ্যে কোন শর্টকাট নেই। ফিট থাকা একটা লাইফস্টাইল যেটা দিনের পর দিন অধ্যাবসায়, সাধনা ও কষ্টের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। ১৫ দিন, একমাসের মধ্যে যেই ফিটনেস অর্জন হবে সেটা কতটা ঠুনকো, তা নিজের বিবেককেই প্রশ্ন করুন।
৭
কিটো ডায়েট বেশ এক্সপেন্সিভ। নিয়মিত ডায়েটের বাইরে গিয়ে আলাদাভাবে জিনিসপত্র কিনতে হয় এই ডায়েটের জন্য। কিটো ডায়েটের মূল নায়ক- চিজ, ঘি, অলিভ অয়েল, এ্যাভাকাডো, ব্রুকলি, নাটস, ক্রিম, সবকটাই এক্সপেন্সিভ।
৮
লাস্ট বাট নট লিষ্ট- আমাদের টেষ্ট বাট ও ফুড হ্যাবিট! আমরা ভাত পাগল জাতি। ১-২ মাস ভাত না খেলে পাগল পাগল অবস্থা হয়ে যায়। আমারতো ১ সপ্তাহ ভাত না খেলেই অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। যারা এই সময় প্লেট ভরে ভাত খায় তাদের যে কি পরিমাণ হিংসার চোখে তাকাই!! আমি জানি আমার মতো অধিকাংশ বাঙ্গালিরই এই অবস্থা। দিনের পর দিন এইরকম ভাত না খেয়ে থাকলে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বেন। মেন্টালি ভয়ংকর রকম স্ট্রং না হলে কিটো ডায়েট আপনার জন্য না। বন্ধুদের খপ্পরে পড়ে বা সামাজিকতা রক্ষা করতে গিয়ে বা মনের প্রাচীরে ফাটল ধরিয়ে যেই একদিন কার্ব নিবেন সেদিনই সর্বনাশের শুরু। কি দরকার শরীর ও মনকে এতো কষ্টের মধ্যে ফেলার। এরচেয়ে ন্যাচারাল ডায়েট করুন। ডায়েট শুড বি সামথিং দ্যাট ইউ এঞ্জয় আ লট। মজা করে ডায়েট করবেন, মেদভূড়ি ঝরিয়ে ফেলবেন।
নেক্সট এপিসোডে আমি কিভাবে ১ বছরে ১২ কেজি ওয়েট কমালাম, সেই গল্প বলবো ইন শা আল্লাহ। আনটিল দেন, কিটোতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে প্লিজ ডু স্টাডি আ লট। শেষ করবো ইন্ডিয়া টাইমস এ কিটো ডায়েট নিয়ে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে দুজন নিউট্রিশনিষ্ট এর মন্তব্য দিয়ে:
Nutritionist Karishma Chawla said- 'Most people love that the keto diet allows you to eat things like cheese and cream, since these are usually off-limits in most weight loss plans owing to their high fat content. What they fail to recognize, however, is that the keto diet is very restrictive, inherently imbalanced and hence, cannot be considered sustainable in the long run. There is also a very specific way to transition into and out of the ketosis state, which most people aren't aware of. As a result, they end up doing themselves more harm than good'
Certified sports nutritionist and fitness trainer Riz Sunny said- 'Weight management has to be a way of life, not a short term plan.'
১) কিটো ডায়েট খুবই রেস্ট্রিক্টিভ একটা ডায়েট। এটা একটা রোগের চিকিৎসা হিসেবে আবিস্কৃত হয়েছিল। রোগীদেরকে চিকিৎসক, নার্স, ডায়েট্রিশিয়ানদের স্ট্রিক্ট এবং কন্ট্রোল্ড সুপারভিশনে এই ডায়েট প্রদান করা হয়। সব ওষুধ যেমন সবার জন্য না, এই ডায়েটও সবার জন্য না। মৃগীরোগী ছাড়াও আরও কিছু রোগের ক্ষেত্রে এই রোগের সুফল পাওয়া গেছে বলে জানা যায়। আপনার ফিজিক, ডিজিজ হিস্ট্রি জেনে কোন ডাক্তার বা নিউট্রিশনিস্ট যদি সাজেষ্ট করে দেন গো ফর কিটো, আদারওয়াইজ প্লিজ ফুলস্টপ।
২) এন্টিবায়োটিকের যেমন কোর্স আছে, কিটোরও তেমন কোর্স আছে। যদি কিটো করতেই হয়, ফুল কোর্স জেনে শুরু করবেন। কিটোতে ঢোকার যেমন প্রসিডিওর আছে তেমনি বের হবারও প্রসিডিওর আছে এবং স্মুথ এক্সিট ইস ভেরি ইম্পর্টেন্ট। কিটোর ৬ সপ্তাহ ৮ সপ্তাহের ডায়েট নিবেন, এক্সিট ডায়েট নিবেন তারপর শুরু করবেন এবং একবার শুরু করলে মাঝপথে থামা যাবে না। মনে রাখবেন আপনি একটা চিকিৎসা নিচ্ছেন। এন্টিবায়োটিক যেমন মাঝপথে বাদ দেন না, কিটোও বাদ দেয়া যাবে না।
৩) কিটো পরবর্তী ডিসিপ্লিন্ড লাইফস্টাইল ইস ভেরি ইম্পর্টেন্ট। কিটোর একটা ভালো দিক আমার কাছে মনে হয়েছে এটা ডিসিপ্লিন্ড হতে সহায়তা করে। কিটো খুব টাফ ডায়েট, বিশেষ করে আমাদের সাউথ এশিয়ান টেস্ট বাটে। সো একবার যারা প্রোপার ওয়েতে এটা ফলো করবে, আশা করা যায় পরবর্তীতেও তাদের জন্য ডিসিপ্লিন্ড ডায়েট ফলো করা ইজি হবে।
৪) কিটো যারা ফলো করেছেন এবং যারা এটার ফ্যান তারাই বলেন, কিটো সবার জন্য না, এটা রেস্ট্রিক্টিভ ডায়েট এবং এর অনেক ক্রিটিসিজম আছে। সো আপনি কেন নিজের জন্য এরকম একটা ডায়েট বেছে নিবেন যেটা আপনার শরীরকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয় বা ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি ঝুঁকি নিতেই হয় তবে টাকা খরচ করেন, ডাক্তারের সাথে (ডাক্তারি আর নিউট্রিশনিষ্ট কিন্তু দুইটা ভিন্ন জিনিস, আমি এখানে ডাক্তার বলতে যিনি নিউট্রিশন নিয়ে কাজ করেন তাকে বুঝিয়েছি) পরামর্শ করেন, গাইডলাইন নেন, দেন গো ফর ইট। অনলাইনের আম ভিডিও বা ডায়েট চার্ট আপনার জন্য না, আপনি স্পেশাল, আপনার জন্য মডিফাই করা ডায়েট চার্ট নিন, নিয়ে শুরু করুন।
৫) ডায়েট শুড বি সামথিং যেটা আপনি এঞ্জয় করেন। শরীরের বিরুদ্ধে, কালচারের বিরুদ্ধে, টেষ্টবাটের বিরুদ্ধে গিয়ে ডায়েট করলে সেটা সাসটেইনেবল হয় না। আর ওয়েট ম্যানেজমেন্ট, ফিট থাকা এটা একটা লাইফস্টাইল, আপনার প্রতিদিনের চেক এ্যান্ড গো, এতে কোন শর্টকাট নেই। এমন ডায়েট বেছে নিবেন না যেটা ধরে রাখতে পারবেন না।
লেখক
ডাঃ আয়েশা রাইসুল (গভঃ রেজিঃ H-১৫৯৮)
বি.এইচ.এম.এস (ঢাঃ বিঃ), এক্স-হাউজ ফিজিসিয়ান
বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতাল।
চেম্বারঃ
খান ক্লাসিকেল হোমিওপ্যাথি।
উওর কাজীপাড়া,মিরপুর, ঢাকা।
হেল্পলাইনঃ 01916-023571, 01976-023572 (রিসিপসন)।
www.facebook.com/Dr.AyeshaRaisul.B.H.M.S