একজন ভালো মানুষ। হঠাৎ তার প্রচন্ড চুলকানি, চাকা চাকা লাল ফুসকুড়ি। এমন সমস্যা প্রকৃতপক্ষে ছোটো মনে হলেও এর ভয়াবহতা আপনাকে মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দিতে পারে। আজকের টপিকস এলার্জি নিয়ে।
বিশ্বে দিনে দিনে কেন খাদ্য অ্যালার্জিক হয়ে উঠছে তার কোন একক ব্যাখ্যা নেই। শরীরে এলার্জি থাকা ভালো। তবে বেশি পরিমান থাকলে তা ক্ষতির মুখে ফেলবে। তবে এ নিয়ে বিজ্ঞানের কিছু তত্ত্ব রয়েছে। তার মধ্যে একটি হল, বর্তমানের উন্নত স্বাস্থ্যবিধি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জ্ঞান না থাকা ও সঠিক লাইফস্টাইল না মেনে না চলা।
খাবারের প্রতি মানুষের ক্রমেই এতোটা সংবেদনশীল বা অ্যালার্জিক হয়ে ওঠার পেছনে আগে পরিবেশগত বিভিন্ন বিষয়কে মূল কারণ বলে ভাবা হতো। জরিপে দেখা গেছে, হাঁপানি ও খাদ্য অ্যালার্জিতে আক্রান্ত পরিবেশগত কারণেই এমনটা হয়ে থাকে। এছাড়া দূষণ, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এবং রোগজীবাণুর সংস্পর্শে কম আসাকেও অ্যালার্জির হার বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ বলে ধরা হয়।
এলার্জি কী
আমাদের শরীর সবসময়ই ক্ষতিকর বস্তুকে (পরজীবী, ছত্রাক, ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া) প্রতিরোধের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধের চেষ্টা করে। এই প্রচেষ্টাকে রোগ প্রতিরোধ প্রক্রিয়া বা ইমিউন বলে। কিন্তু কখনো কখনো আমাদের শরীর সাধারণত ক্ষতিকর নয়, এমন অনেক ধরনের বস্তুকেও ক্ষতিকর ভেবে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। সাধারণত ক্ষতিকর নয়, এমন সব বস্তুর প্রতি শরীরের এই অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াকে এলার্জি বলা হয়। এলার্জি সৃষ্টিকারী বহিরাগত বস্তুগুলোকে এলার্জি উৎপাদক বা এলার্জেন বলা হয়।
এলার্জিজনিত প্রধান সমস্যাসমূহ
এলার্জিজনিত সর্দি বা এলার্জিক রাইনাইটিস এর উপসর্গ হচ্ছে অনবরত হাঁচি, নাক চুলকানো, নাক দিয়ে পানি পড়া বা নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, কারো কারো চোখ দিয়েও পানি পড়ে এবং চোখ লাল হয়ে যায়।
এলার্জিক রাইনাইটিস দুই ধরনের হয়ে থাকে
সিজনাল এলার্জিক রাইনাইটিস
বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় এলার্জিক রাইনাইটিস হলে একে সিজনাল এলার্জিক রাইনাইটিস বলা হয়।
লক্ষণ ও উপসর্গ
ঘন ঘন হাঁচি
নাক দিয়ে পানি পড়া
নাসারন্ধ্র বন্ধ হয়ে যাওয়া
এছাড়াও অন্য উপসর্গগুলো হল –
চোখ দিয়ে পানি পড়া
চোখে তীব্র ব্যথা অনুভব করা।
পেরিনিয়াল এলার্জিক রাইনাইটিস
সারা বছর ধরে এলার্জিক রাইনাইটিস হলে একে পেরিনিয়াল এলার্জিক রাইনাইটস বলা হয়।
পেরিনিয়াল এলার্জিক রাইনাইটিসের উপসর্গগুলো সিজনাল এলার্জিক রাইনাইটিসের মতো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে উপসর্গগুলো তীব্রতা কম হয় এবং স্হায়িত্বকাল বেশি হয়ে থাকে।
অ্যাজমা বা হাঁপানি
কাশি, ঘন ঘন শ্বাসের সঙ্গে বাঁশির মতো শব্দ হওয়া বা বুকে চাপ চাপ লাগা। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝেই ঠান্ডা লাগবে।
অ্যাজমা রোগের প্রধান উপসর্গ বা লক্ষণগুলো হলো
শ্বাস নিতে ও ছাড়তে কষ্ট
বুকের ভিতর বাঁশির মতো সাঁই সাঁই আওয়াজ
ঘন ঘন কাশি
দম খাটো অর্থাৎ ফুসফুস ভরে দম নিতে না পারা
বুকে আটসাট বা দম বন্ধ ভাব
রাতে ঘুম থেকে উঠে বসে থাকা
একজিমা :
একজিমা বংশগত চর্মরোগ, যার ফলে ত্বক শুস্ক হয়, চুলকায়, আঁশটে এবং লালচে হয়। খোঁচানোর ফলে ত্বক পুরু হয় ও কখনো কখনো উঠে যায়। এর ফলে ত্বক জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত ত্বক থেকে চুয়ে চুয়ে পানি পড়ে এবং দেখতে ব্রণ আক্রান্ত বলে মনে হয়। এটা সচরাচর বাচ্চাদের মুখে ও ঘাড়ে এবং হাত ও পায়ে বেশি দেখা যায়।
এলার্জিক কনজাংটাইভাইটিস
এর লক্ষন গুলো হল
চোখে চুলকানো, চোখ লাল হয়ে যাওয়া।
এবার কী কী খাবার আপনাকে বিপদে ফেলবে তা জেনে নেই চলুন
দুধ
আমাদের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় পুষ্টির জন্য দুধের উপর নির্ভরশীল হতে হয় অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু এই তুলনাহীন পুষ্টিদায়ক দুধ খেলেও কারো কারো অ্যালার্জির সমস্যা হয়। বিশেষ করে গরুর দুধে এই সমস্যা দেখা দেয়। যখন গরুকে কোনো কারণে চিকিৎসা দিতে হয় তখন যে দুধ পাওয়া যায় সেখান থেকে এলার্জি হতে পারে। এখানে চিকিৎসা বলতে বোঝানো হচ্ছে, যদি গরুটিকে পেনিসিলন জাতীয় এন্টি বায়োটিক দিতে হয় তখন এটির প্রভাব দুধে চলে আসে। যাদের এলার্জি আছে তারা ওই দুধ খেলে তার এলার্জির সমস্যা হতে পারে। তবে দুধে অ্যালার্জি থাকা আর ল্যাক্টোজ ইনটলারেন্স কখনোই এক নয়। এ বিষয়টি মাথায় রাখবেন।
ডিম
ডিমও একটি পুষ্টিকর ও শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান। তবে ডিম খেলেও অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে বিভিন্ন বয়সের মানুষের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডিমের সাদা অংশে থাকা প্রোটিন থেকে এই অ্যালার্জি হয়। যদি কারও ডিমের কারণে শরীরে এলার্জির সৃষ্টি হয়, তাদের ডিম খাওয়া থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।
বাদাম
বাদাম খেতে সবাই পছন্দ করে। কিন্তু কাজু, পেস্তা, আমন্ড, আখরোট, ব্রাজিল নাট এই ধরনের গাছ বাদাম খেলে অনেকেরই অ্যালার্জি হতে পারে। তবে কোনো এক ধরনের বাদামে অ্যালার্জি থাকা মানেই অন্য বাদামেও অ্যালার্জি হবে এমনটা নাও হতে পারে।যেমন চিনা বাদামে অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে খুব বাজেভাবে। শিশুদের মধ্যে প্রায়ই চিনা বাদামে অ্যালার্জি দেখা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে চিনাবাদাম এলার্জি ৪-৮ শতাংশ শিশু এবং ১-২ শতাংশ বয়স্কদের উপর প্রভাব ফেলে। অনেকের আবার কাজু বাদামে এলার্জি হয়। তাই খেয়াল রেখে ওই বাদামটি এড়িয়ে চলতে হবে।
গ্লুটেন ইনটলারেন্স বা হুইট অ্যালার্জি
এটি সহজে ধরা পড়ে না। মুখে ফোলাভাব, গলা জ্বালা, বমি বমি ভাব এবং ডায়েরিয়া হল এই ধরনের অ্যালার্জির প্রাথমিক লক্ষণ। এই ধরনের সমস্যা দেখা দিলে সপ্তাহ দুয়েক গম জাতীয় খাবার বাদ দিয়ে এরপরে ৪/৫ দিন গম জাতীয় খাবার আবার খেয়ে দেখুন কী পরিবর্তন লক্ষ করছেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে সব থেকে সহজে ও কম খরচে হুইট অ্যালার্জি ধরা পড়বে। পারিবারিক ইতিহাস থাকলে এই অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ধরনের অ্যালার্জিতে বয়স খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে কাজ করে, শিশুদের ক্ষেত্রেই সাধারণত এই অ্যালার্জির প্রকোপ বেশি দেখা যায়।
ফল ও সবজি
অনেকের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ফল ও সবজি থেকে অ্যালার্জি হয়। বেগুন, গাজর, টমেটো, পিচ, শিম ইত্যাদি থেকে অনেকেই অ্যালার্জির সমস্যায় ভোগেন। সেক্ষেত্রে সেসকল খাবার এড়িয়ে যাবেন।
মাছ
মাছের অ্যালার্জি প্রায় ২% প্রাপ্তবয়স্ককে প্রভাবিতো করে বলে জানা যায়। মাছের অ্যালার্জি মারাত্মক। প্রধান লক্ষণগুলি বমি বমিভাব এবং ডায়রিয়া হয়, তবে, বিরল ক্ষেত্রে এনাফিল্যাক্সিসও হতে পারে। আমাদের দেশে চিংড়ি, ইলিশ ইত্যাদিতে এলার্জি হয় বলে জানা যায়। তাই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
সয়াবিন জাতীয় খাবার
শিশুদের ক্ষেত্রে সয়াবিন জাতীয় খাবার থেকে অ্যালার্জি দেখা যায়। সাধারণত সয়া বিনস, সয়া মিট এবং সয়া মিল্কে অ্যালার্জি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ১০ বছর বয়সের পর থেকে কমে আসে। তাই বাচ্চাদের এসকল খাবার থেকে সাবধানে রাখতে হবে।
আরো কিছু সাধারণ খাবার যা অ্যালার্জির অন্তর্ভুক্ত
তিসি, তিল বীজ, পিচ, কলা, অ্যাভোকাডো, কিউই ফল, রসুন, সরিষা বীজ ইত্যাদি।
এবার একটি তথ্য বললে আপনাদের পিলে চমকে যাবে। কী জানতে চান? চলুন জেনে নেই
এলার্জি সমস্যা রক্তের গ্রুপ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন খাদ্যের মাধ্যমে বেশি অনুভূত হয়। যেসব খাবার খেলে এলার্জি সমস্যা বাড়ে সেগুলো নিচে তুলে ধরা হল।
যাদের রক্তের গ্রুপ ও তাদের ক্ষেত্রে
রাজ হাঁস, মাগুর মাছ, শিঙমাছ, চীনাবাদাম, কাজুবাদাম, পোস্তদানা, এভাকাডো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, জলপাই, লাল আলু, বেগুন, আইসক্রিম, দুধ, দই, নারকেল, তেতুল, স্ট্রবেরি, আপেল ইত্যাদিতে এলার্জি বাড়াতে পারে।
যাদের রক্তের গ্রুপ এ তাদের জন্য এলার্জি তৈরী করতে পারে নিচের খাবার গুলোঃ
হাঁসের মাংস, গুরুর মাংস, কোয়েল পাখি, মাগুর মাছ, ডিম, সামুদ্রিক মাছ, মাখন, ঘন দুধ, পেস্তাবাদাম, কাজুবাদাম, মিষ্টি আলু, বেগুন, জলপাই, কমলা, পেপে, আম, টমেটো ইত্যাদি।
রক্তের গ্রুপ বি এর জন্য এলার্জি যুক্ত খাবারের তালিকাঃ
হাঁসের মাংস, কোয়েল পাখি, কাঁকড়া, চিংড়ি, ব্লু চিজ, ভুট্টা, চীনাবাদাম, পেস্তাবাদাম, জলপাই, কুমড়া, টমোটো, আইক্রিম, দুধ, দই, নারিকেল, ডালিম, কামরাঙ্গা, টমেটো ইত্যাদি।
রক্তের গ্রুপ এবি এর জন্য এলার্জি যুক্ত খাবারের তালিকাঃ
হাঁসের মাংস, গরুর মাংস, কোয়েল পাখি, কাঁকড়া, চিংড়ি, ব্লু চিজ, ভুট্টা, তিলের তেল, পোস্তদানা, সূর্যমুখীর বীজ, কুমড়া বীজ, আইসক্রিম, জলপাই, মুলা, কলা, পেয়ারা, নারিকেল, কমলা, ডালিম, নারিকেল, কামরাঙ্গা ইত্যাদি।
লেখক
পুষ্টিবিদ সিরাজাম মুনিরা
কনসালটেন্ট ডায়েটিশিয়ান
ইবনেসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল