বর্তমান বিশ্বে অসংক্রামক ব্যাধিগুলোর মধ্যে কিডনি রোগ অন্যতম। বাংলাদেশে দিন দিন কিডনি রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রাণঘাতী রোগের তালিকায় কিডনি রোগের অবস্থান চতুর্থ। প্রায় ২ কোটি লোক কোনো না কোনো কিডনি রোগে ভুগছেন। ৩০-৪০ হাজার লোক এ রোগে মৃত্যুবরণ করে। নতুন করে ৮-১০ লাখ লোক এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাই কিডনি রোগের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন থাকতে হবে এবং কিডনি বিকল হলে, তার কার্যকারিতা হারানোরোধে প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগকে শনাক্ত করে চিকিৎসা করতে হবে।
আমাদের দেহে প্রতিনিয়ত অসংখ্য জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হচ্ছে। এসব বিক্রিয়ায় উৎপন্ন দূষিত পদার্থ রক্তে মিশে যায়। আর কিডনি তার ছাঁকনির মাধ্যমে রক্তকে ছেঁকে পরিশোধিত করে এবং দূষিত পদার্থগুলো (ইউরিয়া, ইউরিক এসিড, অ্যামোনিয়া, ক্রিয়েটনিন ইত্যাদি) দেহ থেকে মূত্রের সঙ্গে বের করে দেয়। এভাবে কিডনি আমাদের দেহকে বিষাক্ত ও ক্ষতিকর বর্জ্য পদার্থের হাত থেকে রক্ষা করে। এ ছাড়াও কিডনির অন্যান্য কাজ আছে। কিডনি রোগ এমনই মারাত্মক যা কোনো প্রকার লক্ষণ বা উপসর্গ ছাড়া খুব ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে। তাই একে নীরব ঘাতক বলে অভিহিত করা হয়। কখনো কখনো রোগী কোনো উপসর্গ বুঝে ওঠার আগেই কিডনির শতকরা ৭০ ভাগ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
কারন অনুসারে কিডনি রোগগুলোকে সাধানত দুইভাগে ভাগ করা হয়:
১
নেফ্রোলজিক্যাল- বিভিন্ন রকমের গ্লুমেরুলোনেফ্রাইটিসঃ আনকনট্রোল ডায়াবেটিস, আনকনট্রোল ব্লাড প্রেসার, অতিরিক্ত ব্যাথার ওষুধ সেবন, জেনেটিক কারন, এলার্জিক কারন ইত্যাদি।
২
ইউরোলজিকেল- প্রসাবের সমস্যাজনিতঃ প্রসাবের নালী সরু হয়ে যাওয়া, প্রস্টেট সমস্যা, মুত্রথলি, মূত্রনালী বা কিডনী পাথর, জন্মগত প্রসাবের নালী বা কিডনী নালীর ব্লক, কিডনী ক্যানসার ও কিডনি টিবি ইত্যাদি।
কিডনীরোগের লক্ষনসমূহ-
• চোখের চারপাশে ও পায়ের গোড়ালিতে পানি জমা
• ফ্যাকাশে বা রক্ত শুন্যতা
• মাথাব্যথা ও শরীর চুলকানো
• বমি বমি ভাব খাবারের অরুচি
• প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া
• হাত, পা মুখসহ সমস্ত শরীর ফুলে যাওয়া
• শ্বাস কষ্ট
• ঘন ঘন প্রসাব বিশেষ করে রাতে বেশি প্রস্রাব হওয়া
• প্রসাবের জ্বালাপোড়া
• প্রস্রাবের সঙ্গে পাথর বের হওয়া
• প্রসাবের সাথে রক্ত যাওয়া
কিডনী রোগের চিকিৎসা-
সচেতনতা ও দ্রুত রোগ নির্ণয় কিডনী বিকল হওয়া প্রতিরোধের একমাত্র উপায়।প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে ওষুধ দিয়ে নেফ্রোলজিকেল রোগগুলো নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব।ইউরোলজিক্যাল রোগগুলো চিকিৎসার জন্য অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা করলে এই কারনে কিডনী ফেইলর শতভাগ নিয়ন্ত্রন সম্ভব।
কিডনী ফেইলরের চিকিৎসা:
১৷ ডায়ালাইসিস – মেশিনের মাধ্যমে বিকল্প উপায়ে কিডনীর মতো শরীর থেকে দুষিত পদার্থ বের করে নেয়া। সপ্তাহে সাধারনত দুই তিনবার হসপিটালে গিয়ে ডায়ালাইসিস নিতে হয়। ব্যয়বহুল ও অনেক অসুবিধা রয়েছে।
২৷ ট্রান্সপ্লানটেশন-ডোনারের শরীর থেকে একটি কিডনী নিয়ে রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন। অধিক জনপ্রিয়। বাংলাদেশে বছরে প্রায় শতাধিক কিডনী ট্রান্সপ্লানটেশন হয়। কিন্তু ডোনার সমস্যা বেশ প্রকট। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী নিকটাত্মীয় (বাবা মা, ভাইবোন, আপন খালা মামা, ফুফু চাচা, স্বামী স্ত্রী, আপন কাজিন) ছাড়া কেউ কিডনীদান করতে পারেনা। মৃত ব্যক্তির কিডনী প্রতিস্থাপনের আইন থাকলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় চালু করা যাচ্ছেনা বাংলাদেশে।
কিডনী রোগ প্রতিরোধ:
১
পরিমিত ও বিশুদ্ধ পানিপান ( পানির কোন পরিমান নির্ধারিত নেই। তৃষ্ঞা দ্বারা পরিমান নির্ধারিত হবে। কম পানি খাওয়া যেমন ক্ষতিকর তেমনি বেশি পানি খাওয়াও উচিত নয়)।
২
সুস্থ মানুষের কিডনী সুস্থ রাখার জন্য খাবারের বিশেষ কোন মেনু নেই।
৩
গরমের কারনে বা ডায়রিয়াজনিত কারনে পানিশুন্যতা দেখা দিলে দ্রুত পুরন করতে হবে।
৪
রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিত ওষুধ সেবনে বিরত থাকতে হবে।
৫
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন করতে হবে।
৬
উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে।
৭
যাদের বংশগত কিডনি রোগ আছে তাদের বছরে কমপক্ষে একবার কিডনি চেক আপ করা উচিত।
সর্বোপরি সরকারীভাবে বিনামূল্যে ইউনিয়ন পর্যায়ে কিডনীরোগ স্ক্রিনিং ব্যাবস্থা চালু করা পাশাপাশি সরকারী জেলা হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে ডায়ালাইসিস এর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি।
লেখক
ডাঃ মোহাম্মদ ইব্রাহিম আলী
এম.বি.এস,বিসিএস (স্বাস্থ্য)
এমএস (ইউরোলজি)
ফেলোশীপ ইন ইউরোলজি (ইউএএ,মালয়েশিয়া)
আবাসিক সার্জন (ইউরোলজি)
ইউরোলজি বিভাগ
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
রোগী দেখার সময়
প্রতিদিন বিকাল
৩.০০ থেকে ৮.০০ টা পর্যন্ত
শুক্রবার বন্ধ
লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে নিচের ফেসবুক পেইজে ক্লিক করুন
www.facebook.com/Dr-Ibrahim-Urologist-Bangladesh-770739179933378