সুপারবাগ নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে চারপাশে। সুপারবাগ কি শেষ পর্যন্ত মানব সভ্যতার জন্য বড় হুমকি হয়ে আসছে? মানবজাতি কি শেষ পর্যন্ত সুপারবাগেই কুপোকাত হবে? নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষের মনে, অনলাইনে নানা লেখায়, ইন্টারভিউতে, বিশেষজ্ঞদের গবেষনাতে উঠে আসছে সুপারবাগ ইস্যু।
মূল আলোচনায় যাবার আগে জেনে নেই
সুপার বাগ আসলে কি?
সুপারবাগ আসলে আলাদা কিছুনা। ব্যাক্টেরিয়াগুলো যখন এন্টিবায়োটিক এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তখন তাকে বলে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া। এরই আরেক নাম সুপার বাগ৷
কিভাবে জন্ম নেয় সুপারবাগ?
এটা আসলে এক ধরণের জীবের বিবর্তন। একটি এন্টিবায়োটিক যখন দিনের পর দিন ব্যবহৃত হতে থাকে তখন প্রকৃতির নিয়মেই ব্যাক্টিরিয়াগুলো নিজেদের জিনে বিশেষ কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ব্যাবস্থা গড়ে তোলে। এটি ব্যক্টিরিয়ার অস্তিত্বের লড়াই। যাকে বলে সারভাইভাল ইন্সটিংক্ট।
এটা কি নতুন কিছু?
না নতুন কিছুনা। এন্টিবায়োটিকের ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়। মাত্র আশি বছর আগে এন্টিবায়োটিক আসে পৃথিবীতে৷ তার আগ পর্যন্ত এন্টিবায়োটিক বলে কিছু ছিলইনা।
এন্টিবায়োটিক পূর্ব সময়ে মানুষ জীবানুর বিরুদ্ধে লড়াই করত নিজেদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সম্বল করে। খুব যে পেরে উঠতো তাও না। সিফিলিস, প্লেগ, কলেরার মত সংক্রামক রোগে মানুষ মারা যেত হাজারে হাজারে।
আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কারের পর একটা জাদুকরী পরিবর্তন এলো। সবাই বিস্ময় নিয়ে লক্ষ করলো সিফিলিস, টাইফয়েড, ক্ষত সংক্রমণের মত অসুখ সহজেই ভাল হয়ে যাচ্ছে। সবাই একে মিরাকল বলে আখ্যা দিল। কিন্তু পেনিসিলিন আবিষ্কারের দশ বছর না যেতেই এমনকি পেনিসিলিন আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানী ফ্লেমিং নোবেল পাবার আগেই পেনিসিলিন প্রতিরোধী ব্যক্টিরিয়া আবির্ভূত হলো। ব্যক্টিরিয়াগুলো তাদের কোষ আবরনীর চার পাশে প্রোটিনের বিশেষ প্রাচীর তৈরি করলো যা ভেদ করে পেনিসিলিন ভেতরে ঢুকতে পারেনা।
কিন্তু বিজ্ঞানও থেমে থাকেনি। নতুন নতুন প্রযুক্তির এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার করে ব্যক্টিরিয়াকে ধরাশায়ী করেছে। এভাবেই চলেছে গত আশি বছর।
কিন্তু হঠাৎ সুপারবাগ নিয়ে এত হৈচৈ কেন?
হৈ চৈ এ কারণে যে নানা কারণে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধের হার বেড়ে গেছে আশংকাজনকভাবে৷ নতুন নতুন জেনারেশনের এন্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তারচেয়ে বেশি গতিতে বাড়ছে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যক্টিরিয়া।
কেন বাড়ছে?
বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এন্টিবায়োটিক নামক মোক্ষম অস্ত্রটি সহিজলভ্য হওয়ায় বেড়েছে এর যথেচ্ছ ব্যাবহার। এটাই প্রধান কারণ। প্রয়োজন ছাড়াই ওভার দ্যা কাউন্টার (প্রেস্ক্রিপশন ছাড়া ভোক্তার নিজের ইচ্ছায়) এন্টিবায়োটিক কিনে খাওয়া, পুরো কোর্স না খাওয়া, অর্থাৎ মাঝ পথে এন্টিবায়োটিক খাওয়া ছেড়ে দেওয়া ইত্যাদির কারণে সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে সুপারবাগ। আন রেজিস্টার্ড হাতুড়ে চিকিৎসক কর্তৃক (অনেকসময় রেজিস্টার্ড ডাক্তারও) আন্দাজে ঢিল ছোড়ার মত অহেতুক এন্টিবায়োটিক প্রেস্ক্রাইব করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হয়েছে আই সি ইউ তে ঘাপটি মেরে থাকা একধরণের প্রতিরোধী জীবানু। যারা হাসপাতাল বা আইসিইউতেই থাকে৷ নানারকম এন্টিবায়োটিক খেয়ে তারা প্রতিরোধী হয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে। আইসিউতে ভেন্টিলেটর সার্কিট সহ বিভিন্ন যন্ত্র নিয়মিত জীবানুমুক্ত না করলে এবং একই যন্ত্র জীবানুমুক্ত না করে বারবার ব্যবহার করলে সুপারবাগের জন্ম হয়। আমাদের দেশের আইসিইউ গুলোতে এই সমস্যা বেশ প্রকট।
সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা বেশ ভীতির জন্ম দিয়েছে। বংগবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববদ্যালয়ের আইসিইউতে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ৯০০ রোগীর ভেতর ৪০০ রোগী মারা গেছে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যক্টিরিয়ার কারণে৷ সর্বোচ্চ মাত্রার এন্টিবায়োটিক দিয়েও এদের সারানো যায়নি।
এটি একটি বিরাট অশনি সিংকেত। বিএসএমএমইউ এর আইসিউ তবু অনেকখানি নিয়ন্ত্রিত ও মানসম্পন্ন। এদেশে ব্যংগের ছাতার মত গড়ে উঠেছে যেসকল আইসিইউ সেখানে কি হচ্ছে তা কল্পনা করলেও ভয় হয়৷
এখন তাহলে করনীয় কি?
করনীয় হলো রেজিস্টার্ড এমবিবিএস ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ফার্মেসি ওয়ালা, হাতুড়ে ডাক্তার, চিকিৎসা সহকারি কারো পরামর্শে এন্টিবায়োটিক খাওয়া যাবেনা৷ নিজের ইচ্ছাতে তো নয়ই। রেজিস্টার্ড ডাক্তার প্রেসক্রাইব করলে পুরো কোর্সের এন্টিবায়োটিক খেতে হবে একদম নিয়ম মেনে। মাঝপথে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করা যাবেনা। ডাক্তারদেরও এন্টিবায়োটিক প্রেস্ক্রাইব করার ক্ষেত্রে সাবধান হতে হবে৷ আইসিইউগুলো নিয়মিত মনিটর করতে হবে। তারা নিয়মিত জীবানু নিরোধক কার্যক্রম পরিচালনা করে কিনা সেটা তদারক করতে হবে৷
উন্নত দেশে সুপারবাগ নিয়ে বেশ তোড়জোড় চলছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যেসব দেশে সুপারবাগের জন্ম হচ্ছে বেশি সেইসব তৃতীয় বিশ্বের দেশে একে নিয়ে তেমন সচেতনতা বা কর্মকান্ড নেই।
সুপারবাগের ফলে মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে এরকম কথা বলা যায়না। কিন্তু মানুষের মৃত্যু হার বেড়ে যাবে অনেকগুন। বিরূপ প্রভাব পড়বে সামষ্টিক অর্থনীতিতেও। সময় থাকতে সচেতন না হলে মানব জাতি নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে এটা নিশ্চিত বলা যায়।
এই লেখকের সব লেখা পড়ুন নিচের লিংক থেকে।
www.royalbangla.com/gulzarhematologist
লেখক
ডাঃ গুলজার হোসেন
বিশেষজ্ঞ হেমাটোলজিস্ট
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল
চেম্বারঃ
বি আর বি হাসপাতাল পান্থপথ, ঢাকা।
লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে নিচের ফেসবুক পেইজে ক্লিক করুন
www.facebook.com/gulzarhematologist