মূত্রতন্ত্রের পাথর একটি অন্যতম ইউরোলজিক্যাল সমস্যা। এর কারনে মুত্রনালীর সংক্রমন, হাল্কা থেকে প্রচন্ড ব্যাথা এমনকি কিডনী ফেইলরও হতে পারে। এজন্য মূত্রতন্ত্রের পাথর সম্পর্কিত প্রাথমিক জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক।
মূত্রতন্ত্রের পাথর সমস্যা কি?
মূত্রে থাকা অম্লীয় ও ক্ষারীয় পদার্থের স্ফটিক (crystal) সমূহ কোন কারনে জমাট বেধে একত্রিত হয়ে দানাদার পদার্থে রুপান্তরিত হয়ে পাথর তৈরী করে। ছোট ছোট পাথর কনাগুলো সাধারনত প্রসাবের সাথে বের হয়ে যায়। অনেকগুলো কনা জমে বড় আকারের পাথর তৈরী হলে তা কিডনী বা মূত্রতন্ত্রের যেকোন স্থানে আটকে গিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করে।
কারনঃ
মূত্রতন্ত্রের পাথরের প্রকৃত কারন এখনও অজানা। কারো কারো মতে খাদ্র্যাভাস এ রোগের কারন। কিন্তু একই খাবার খেয়ে পরিবারের সবার কিন্ত কিডনীতে পাথর হয়না। অনেকেই নিম্নলিখিত কারনগুলোকে দায়ী করে থাকেন-
১। কম পানি খাওয়ার অভ্যাস অথবা গ্রীষ্মপ্রধান দেশে বাস করা
২। ঘনঘন মূত্রতন্ত্রের সংক্রমন
৩। মূত্রতন্ত্রের জন্মগত গঠনগত সমস্যা
৪। মূত্রতন্ত্রের মূত্র সঞ্চালনে অবরোধ
৫। দীর্ঘ সময় শয্যাশায়ী থাকা
৬। প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা
৭। অধিকমাত্রায় ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন সি সেবন
৮। রক্তের ইউরিক এসিড আধিক্য ইত্যাদি।
লক্ষনসমূহঃ
অনেক রোগীর কোন উপসর্গ থাকেনা। তবে অধিকাংশ রোগী নিম্নলিখিত সমস্যা নিয়ে আসতে পারে-
১। কোমরের দুইপাশ থেকে কুচকি হয়ে নাভির নিচ পর্যন্ত ব্যাথা- পাথরের অবস্থান অনুসারে ব্যাথার অবস্থান ও তিব্রতা ভিন্ন হতে পারে।
২। প্রসাবে জ্বালাপোড়া বা ঘনঘন সংক্রমন
৩। প্রসাবের সাথে রক্ত যাওয়া
৪। জ্বর, বমি বমি ভাব, শরীর ফুলে যাওয়া
৫। প্রসাবের সাথে ছোট ছোট পাথরকনা যেতে পারে।
রোগ নির্ণয়ঃ
সাধারন কিছু পরীক্ষাতেই পাথর রোগ ডায়াগনোসিস করা যায়-
১। আলট্রাসনোগ্রাম (USG)
২। উইরিন আরএমই (Urine RME)
৩। রক্তের ক্রিয়েটিনাইন মাত্রা (S. Creatinine)
৪। এক্স রে কেইউবি (X Ray KUB)
৫। আইভিইউ/সিটি স্ক্যান (IVU/CT)
চিকিৎসাঃ
মূত্রতন্ত্রের সব পাথরের চিকিৎসা প্রয়োজন হয়না। ছোট ছোট পাথরকনা সাধারন প্রস্রাবস্রোতেই বের হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের রোগীদের বেশি করে পানি খেতে বলা হয় এবং হাল্কা দৌড়ঝাপ করতে বলা হয়। পাথর যদি মূত্রতন্ত্রের কোথাও ব্লক করে বা ব্লক করার সম্ভাবনা থাকে তাহলেই কেবল চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। পাথরের চিকিৎসার সময় পাথরের আকার, অবস্থান, রোগীর বয়স, উপসর্গ এবং কিডনীর গঠন ও কার্যকারীতা বিবেচনা করে অপারেশন পদ্ধতি নিরাধারন করা হয়।
দুই ধরনের চিকিৎসা রয়েছে-
১। ওষুধের সাহায্যে চিকিৎসা- কিছু ওষুধ রয়ছে পাথরকে দ্রবীভুত করে, কিছু ওষুধ মূত্রনালীকে প্রসারিত করে পাথর বের হতে সাহায্য করে। সাধারনত ছোট পাথর, কিডনীকে ক্ষতিগ্রস্থ করেনি এমন ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরন করা হয়।
২। অপারেশন-
ক। পেট না কেটে- এটা আধুনিক ও সর্বাধিক গ্রহনযোগ্য চিকিৎসা। প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে পেট না কেটে অত্যাধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে পাথর বাইরে থেকে ভেঙ্গে গুড়া করা হয় অথবা বের করা হয়। প্রস্রাবের নালীতে সরু যন্ত্র ঢুকিয়ে তার অগ্রভাগের ক্যামেরায় পাথর দেখে তা লেজার বা অন্যান্য এনার্জী প্রয়োগ করে ভেঙ্গে বের করা হয়। কখনও কখনও পেছনের দিকে ছোট একটি ছিদ্র করে তার ভিতর দিয়ে সুক্ষ যন্ত্র ঢুকিয়ে কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে পাথর অপারেশন করা হয়। রোগীদের অনেকের ভ্রান্তধারনা রয়েছে যে এই পদ্ধতিতে পাথর থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা সঠিক নয়। এটিই মূত্রতন্ত্রের পাথর চিকিৎসার সর্বাধুনিক পদ্ধতি যা উন্নত দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে।
খ। পেট কেটে পাথর চিকিৎসা। এটি পূর্বের সনাতন চিকিৎসা পদ্ধতি যা উন্নত দেশে আর ব্যবহৃত হচ্ছেনা। আমাদের দেশে এই পদ্ধতিতেও পাথর চিকিৎসা করা হচ্ছে। যেখানে আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই বা উপযুক্ত ইউরোলজিস্ট নেই, সেখানে পেট কেটে পাথর চিকিৎসা হচ্ছে। পেটে অনেক লম্বা জায়গা কেটে এই চিকিৎসা হয় বলে এর পার্শপ্রতিক্রিয়া বেশি।
প্রতিরোধঃ
১। পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। পানি পানের আদর্শ কোন পরিমান নেই। এটা নির্ভর করে মানুষের বয়স, ওজন, লাইফস্টাইল ও আবহাওয়ার উপর। এমনভাবে পানি খেতেহবে যেন প্রতিদিন প্রস্রাবের পরিমান দেড় থেকে দুই লিটারের কম না হয়।
২। পূর্বে ধারনা করা হতো ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবারে মূত্রতন্ত্রের পাথর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষনায় দেখা গেছে ক্যালসিয়াম মূত্রতন্ত্রের পাথর প্রতিরোধে সহায়ক। ধারনা করা হচ্ছে রক্তের অতিরিক্ত ফসফেট, অক্সালেট এর সাথে যৌগ গঠন করে এসব আয়নকে মূত্রের মাধ্যমে বের হতে বাধা দেয়। ফলে মূত্রে পাথর তৈরীর সম্ভাবনা কমে যায়।
৩। অক্সালেট সমৃদ্ধ পাথর প্রতিরোধের জন্য নিম্নলিখিত খাবার কম খেতে হবে- পালংশাক, টমেটো, বেগুন, ঢেরস,আঙ্গুর, আমলকি, পেপসি, কোকাকোলা ইত্যাদি।
৪। ইউরিক এসিড সমৃদ্ধ পাথরের জন্য নিম্নলিখিত খাবার কম খেতে হবে- ফুলকপি, কুমড়া, মাশরুম, মসুরডাল, মটরডাল, খাসি, গরু ইত্যাদি।
৫। আনারস, কলা, গাজর, বাদাম ইত্যাদি পাথর প্রতিরোধে সহায়তা করে।
সময় মতো উপযুক্ত চিকিৎসা না করলে মূত্রতন্ত্রের পাথরের কারনে কিডনী ফেইলর হয়ে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। তাই ভয় নয়, সচেতনতাই পারে এই রোগ থেকে মুক্তি দিতে।
লেখক
ডাঃ মোহাম্মদ ইব্রাহিম আলী
এম.বি.এস,বিসিএস (স্বাস্থ্য)
এমএস (ইউরোলজি)
ফেলোশীপ ইন ইউরোলজি (ইউএএ,মালয়েশিয়া)
আবাসিক সার্জন (ইউরোলজি)
ইউরোলজি বিভাগ
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
রোগী দেখার সময়
প্রতিদিন বিকাল ৩.০০ থেকে ৮.০০ টা পর্যন্ত
শুক্রবার বন্ধ
www.facebook.com/Dr-Ibrahim-Urologist-Bangladesh-770739179933378