মূত্রনালির সংক্রমণ (ইংরেজিঃ urinary tract infection) বা ইউটিআই (UTI) হল মূত্রনালির এক ধরনের ব্যাকটেরিয়াঘটিত সংক্রমণ। যখন এর ফলে মূত্রনালির নিম্নাংশ আক্রান্ত হয়, তখন তাকে মূত্রথলির সংক্রমণ (বা সিস্টাইটিস) বলে আর যখন এর ফলে মূত্রনালির ঊর্ধ্বাংশ আক্রান্ত হয়, তখন তাকে কিডনির সংক্রমণ (বা পায়েলোনেফ্রাইটিস) বলে । মূত্রনালির নিম্নাংশের সংক্রমণের ক্ষেত্রে যেসব উপসর্গ দেখা যায় সেগুলো হল মূত্রত্যাগের সময় ব্যথা অনুভব করা, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া এবং মূত্রথলি খালি থাকা সত্ত্বেও প্রস্রাব করার প্রয়োজন অনুভূত হওয়া। তবে যাদের পায়েলোনেফ্রাইটিস হয়, তাদের ক্ষেত্রে সাধারণত মূত্রনালির নিম্নাংশের সংক্রমণে যেসব উপসর্গ দেখা যায় সেগুলো ছাড়াও, জ্বর এবং পার্শ্বদেশে ব্যাথা (Flank pain) থাকতে পারে। কদাচিৎ প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তও আসতে পারে। খুব বয়স্ক এবং খুব কম বয়সীদের ক্ষেত্রে উপসর্গগুলো অস্পষ্ট বা অনির্দিষ্ট ধরনের হতে পারে। পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে এই সংক্রমণে বেশি দেখা যায়। নারীদের ক্ষেত্রে এ সংক্রমণ প্রধানত ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়। প্রতি বছর প্রায় ১০% নারীর মূত্রনালির সংক্রমণ হয় এবং অর্ধেক সংখ্যক নারীই জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও এই সংক্রমণের শিকার হন। ১৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সে এ সংক্রমণ বেশি হয়। প্রায়শই এই সংক্রমণের পুনঃসংঘটন দেখা যায়। সেই প্রাচীন কাল থেকেই মূত্রনালির সংক্রমণের বর্ণনা পাওয়া যায়।
কি ভাবে শহুরে জীবন যাপনের প্রণালী ইউ টি আই এর মতো রোগ সৃষ্টি করতে পারে সে বিষয়ে নজর দিব। ঢাকা শহর তথা সমগ্র শহর এলাকায় রাস্তাঘাটে নারীদের জন্য টয়লেটের ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল। কোন কোন জায়গায় টয়লেট থাকলেও বেশির ভাগ সময় সেগুলো একেবারেই ব্যবহারের অনুপযোগী। এ কারণে পথে ঘাটে টয়লেটে যাওয়ার দরকার হলে খুবই বিপদে পড়েন অনেক নারী। এজন্য নারীদের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে টয়লেট চেপে রাখা এবং পথে যাতে টয়লেট না চাপে সেজন্য কিছু না খাওয়া বিশেষ করে পানি পান না করার প্রবণতা দেখা যায়। দীর্ঘ সময় পায়খানা ও প্রস্রাব চেপে রাখার ফলে নারীরা নানা রকম শারীরিক জটিলতার মধ্যে পড়েন। বিষেশজ্ঞেরা বলছেন, কেবল নারীরা নন, এজন্য পুরুষেরাও ভুগতে পারেন মূত্রনালিতে সংক্রমণসহ নানা ধরণের জটিলতায়।
জটিলতার ধরনঃ
চিকিৎসকের মতে টয়লেট চেপে রাখার কারণে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন নারীরা। এজন্য মূত্রনালির সংক্রমণসহ নানা ধরণের সমস্যা হতে পারে। 'এর ফলে সবচেয়ে বেশি হয়, ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশন বা ইউটিআই, যাকে বলা হয় মূত্রনালির সংক্রমণ। এটা হয়ই বেশিক্ষণ প্রস্রাব চেপে রাখলে ব্লাডারে যে জীবাণু জন্মায় তা থেকে। এটা পরবর্তীতে অন্য সমস্যা তৈরি করে। যেমন বারবার যদি কারো ইউটিআই হয়, তাহলে তা নারীর প্রজনন ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।' প্রস্রাবে ইউরিয়া এবং অ্যামিনো অ্যাসিডের মতো টক্সিন জাতীয় পদার্থ থাকে। ফলে বেশিক্ষণ চেপে রাখার ফলে বিষাক্ত পদার্থ কিডনিতে পৌঁছে কিডনিতে স্টোন বা পাথর তৈরি করতে পারে।
'এছাড়া প্রস্রাব চেপে রাখার কারণে ব্লাডার ফুলে যেতে পারে। সেই সঙ্গে কারো যদি আগে থেকে কিডনিতে কোন সমস্যা থাকে এবং সে নিয়মিত প্রস্রাব চেপে রাখে তাহলে ক্রমে তার কিডনি কার্যক্ষমতা হারাতে শুরু করবে ।'
এজন্য রক্তের বিভিন্ন সংক্রমণসহ নানা ধরণের সংক্রমণ হতে পারে।
কেবলমাত্র টয়লেট চেপে রাখার কারণে শ্বাসকষ্ট এবং ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণও হতে পারে। এছাড়া প্রস্রাব করার সময়ে প্রচণ্ড ব্যথাও অনুভব করতে পারেন একজন মানুষ।
পস্রাবের জটিলতা ও কী তার প্রতিকারঃ
চিকিৎসক, গবেষক এবং সামাজিক বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশে শহুরে এলাকার কর্মজীবী নারীরা এবং শিক্ষার্থীরাই মূলত বাড়ির বাইরে বের হলে টয়লেট চেপে রাখেন।
এজন্য কেবল রাস্তাঘাটে পাবলিক টয়লেটের অপ্রতুলতা দায়ী তা নয়। কর্মস্থল, শপিং মল, হাসপাতাল কিংবা পার্কের মত পাবলিক প্লেসে টয়লেটের বিশেষ করে ব্যবহার উপযোগী টয়লেটের অপ্রতুলতা দায়ী।
তবে, টয়লেট চেপে রাখার কারণে কত নারী সমস্যায় পড়েন কিংবা কী ধরণের সমস্যা বেশি হয়, তা নিয়ে কোন গবেষণার কথা জানা যায় না
এক গবেষণা জরিপে দেখা গেছে রাস্তায় কর্মরত অবস্থায় নারী পুলিশ সদস্যরা টয়লেট চেপে রাখার কারণে অনেকেই ইউরিন ইনফেকশনসহ নানা ধরণের সমস্যায় ভুগছেন। টয়লেট চেপে রাখা ঠেকাতে নারীদের নিজেদের শরীরের ব্যপারে সচেতন হতে হবে। অর্থাৎ টয়লেট পেলে চেপে না রেখে মোটামুটি ব্যবহারযোগ্য একটি জায়গায় গিয়ে কাজ সেরে ফেলতে হবে। এক্ষেত্রে বাড়ির মেয়েটিকে সচেতন করা এবং উৎসাহ দিতে পরিবারকে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবেঃ
যখনই কোন নারীর প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হবে, প্রস্রাবের রাস্তায় চুলকানি হবে এবং তলপেটে ব্যথা হবে, তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এই রোগটি জীবাণু দ্বারা হয়ে থাকে বলে একবার ইউটিআই হয়ে গেছে এমনটা নির্নয় হলে তখন অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া উপায় থাকে না। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে রোগীক সুস্থ করে তোলে। কিন্তু বাজারে তো অনেক ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায় কিন্তু সব অ্যান্টিবায়োটিকই যে একজন রোগীর কাজ করবে এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। এটা নির্ভর করে ঐ রোগী কী জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন তার উপর। কারণ এক এক অ্যান্টিবায়োটিক এক এক জীবাণুর প্রতি সংবেদনশীল। তাই ওষুধ খাওয়ার আগে পরিপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ীই খাওয়া উচিত। অনেকের দেখা যায় সঠিক চিকিৎসার অভাবে এই রোগ বারবার ফিরে আসে, সেক্ষেত্রে অল্প মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা বেশ কার্যকরী।
প্রতিকারে যা করতে পারেন
(১) প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন । দিনে কমপক্ষে ৮ গ্লাস বা অন্তত ৩ লিটার পানি পান করুন।
(২) যখনই প্রস্রাবের বেগ আসবে সাথে সাথে প্রস্রাব করে ফেলুন, আটকিয়ে রাখবেন না।
(৩) পানির পাশাপাশি তরল খাবার যেমন ফলের জুস, ডাবের পানি ইত্যাদি বেশি বেশি পান করুন।
(৪) পাবলিক টয়লেট ব্যবহারের সময় খেয়াল রাখবেন সেটি পরিষ্কার কিনা। হাই কমোড ব্যবহারের সময় সেটা পানি দিয়ে ধুয়ে নিবেন, যদি সম্ভব না হয় তাহলে কমোডের উপর টিস্যু পেপার বিছিয়ে নেবেন এতে করে জীবাণু সহজে আপনার শরীরের সংস্পর্শে আসতে পারবে না।
(৫) একই কাপড় না ধুয়ে বেশিদিন পরিধান করা থেকে বিরত থাকুন। প্যান্টি নিয়মিত ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। কারণ অনেকদিন যাবত না ধুয়ে ব্যাবহার করলে তাতে জীবাণু বাসা বাধে এবং সংক্রমণ করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
(৬) প্রস্রাবের পর যৌনাঙ্গ ভালো করে ধুয়ে নিন। মনে রাখবেন, যৌনাঙ্গ পরিষ্কার করার সময় সবসময় সামনে দিক থেকে পেছনে যাবেন, পেছন থেকে সামনে নয়। তা না হলে মলদ্বার থেকে জীবাণু সামনে চলে এসে সংক্রমণের ভয় থাকে।
(৭) সহবাসের পরে অবশ্যই বাথরুমে যান। ব্লাডার খালি করে দেওয়াই ভালো। কেননা ইন্টারকোর্সের সময় ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। সেখান থেকে বিভিন্ন ইনফেকশন হতে পারে। এছাড়াও সেক্সের সময় ব্যবহৃত গর্ভনিরোধ থেকেও সংক্রমণ হতে পারে।
(৮) সর্বপোরি পার্সোনাল হাইজিন বা ব্যক্তি জীবনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শতকরা ৬০ ভাগ মহিলা জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে একবার হলেও ইউটিআই-এ আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এই রোগটি সম্পূর্ণ ব্যক্তি জীবনের লাইফস্টাইলের উপর নির্ভরশিল। এটি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে সংক্রমিত হয় না। এতে প্রথম দিকে তেমন কোন সমস্যা না হলেও বারবার হতেই থাকলে ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে যে কারো জীবনে। তাই সময় থাকতেই নিজের যত্নে সচেতন হন। বিশেষ করে এই উপসর্গগুলো যদি বারবার ঘটে তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।
এই লেখকের সব লেখা পড়ুন নিচের লিংক থেকে।
www.royalbangla.com/DrMuhid
লেখক
ডা. মুহম্মদ মুহিদুল ইসলাম
সায়েন্টিফিক অফিসার
বিআইএইচএস হসপিটাল কোভিড-১৯ ল্যাব, ঢাকা
অনলাইন কনসালট্যান্ট ,বায়োমেড ডায়াগনস্টিক এন্ড রিসার্চ ল্যাবরেটরি
চিকিৎসা পরামর্শ নিতে এপয়েন্টমেন্ট নিন:
০১৬৮১২৫৬৩৩১
লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে নিচের ফেসবুক পেইজে ক্লিক করুন
www.facebook.com/DrMuhid