ডেংগি আবার হানা দিয়েছে। বেশ কজন মারা গেছেন সম্প্রতি। অনেক কনফিউশন আছে ডেংগি নিয়ে। সাধারণ মানু্ষ এবং ডাক্তার উভয় পক্ষেই আছে কিছু ভুল জানাজানি। ডেংগি রোগে প্লেইটলেট কাউন্ট এবং এর ট্রান্সফিউশন নিয়ে রোগীরা আতংক ও নানারকম বিভ্রান্তিতে ভুগতে থাকে। সমস্যা হচ্ছে শুধু রোগী না বড় বড় ডাক্তাররাও এই প্লেইটলেট কমে যাওয়া নিয়ে বিরাট আতংকে ভুগতে থাকেন। রোগীদেরও আতংকিত করেন। প্লেইটলেট কি, তার কাজ কি, কিভাবে কাজ করে সেটা নিয়ে ঠিক মত মাথা খাটালে এই আতংকটা থাকার কথা ছিলনা। কেউ কেউ প্রোফাইলেকটিক(আগাম সতর্কতা মূলক) প্লেইটলেট দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। এজন্য তারা কিছু নিজস্ব যুক্তিও তৈরি করেন।
যেমন :
১. রুগী খারাপ হয়ে গেল তারপর প্লেইটলেট দিব?
২. যখন প্রয়োজন পড়বে তখন তো রেডি করতে করতে দেরি হয়ে যাবে। রোগী যদি খারাপ হয়ে যায় ততক্ষণে!
৩. বাড়ায়ে রাখলাম, ক্ষতি তো নাই।
এগুলো মূলত মন গড়া, আতংকপ্রসূত এবং স্যরি টু সে, বিষয়টি অনেকখানি অজ্ঞতা প্রসূত।
১ .নম্বরের উত্তর হলো আপনি কখন প্লেইটলেট দেবেন তার একটা গাইডলাইন আছে। রক্ত ক্ষরণের চিহ্ন দেখা দিলে এবং প্লেইটলেট কাউন্ট বিশ হাজারের নিচে নামলে তবেই প্লেইটলেট দেবার কথা ভাবতে পারেন।
২. প্লেইটলেট কমে যাওয়া (থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া) কোন মেডিকেল ইমারজেন্সি না। মানে প্লেইটলেট কমে যাওয়া মাত্র রোগী রক্তক্ষরণ হয়ে ঠাস করে মরে যাবে এরকমও না। সময় পাবেন। প্লেইটলেট কমলে মূলত একধরণের মাইনর ক্যপিলারি ব্লিডিং হয়। ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ বা এইসব।
৩ নম্বর পয়েন্টটা ছিল বাড়ায়ে রাখলাম ক্ষতি তো নাই
উত্তর, অবশ্যই ক্ষতি আছে। আপনি অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিলেন। একেতো ডেংগি শক সিন্ড্রোমের আশংকা, তার উপর এই ট্রান্সফিউশন দিয়ে আপনি রোগীর কম্পলিমেন্ট সিস্টেমকে আরো উত্তেজিত করে তুললেন।সুতরাং বুঝতেই পারছেন খুব প্রয়োজন ছাড়া এই জিনিস দেয়া মূলত বাড়তি কিছু ঝুঁকি নেয়া।
কথা আরো আছে, আপনি এই এক ইউনিট আগাম প্লেইটলেইট দিয়ে কি এমন উদ্ধার করবেন?
প্লেইটলেট উৎপাদন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটা প্রতি নিয়ত তৈরি হচ্ছে এবং ভাংছে। আপনার এই আগাম পাঁচ দশ হাজার প্লেইটলেট যোগ করা আর না করা প্রায় সমান কথা৷ ইনফেকশন হতে পারে এই ভেবে আগাম এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন দেয়াটা যেই মাপের অপচিকিৎসা এটাও সেই মাপের অপচিকিৎসা।
কখন দেবেন?
প্লেইটলেট তখনই দেবেন যখন রক্তক্ষরণের চিহ্ন দেখা দেবে শরীরে। র্যাশ হবে, রক্তক্ষরণ হবে কেবল তখনই দিতে পারেন প্লেইটলেট। আর রক্তক্ষরণের চিহ্ন দেখলেই আতংকিত হবেন না৷ এইটুকু রক্তক্ষরণে কিছু হবেনা। রক্তক্ষরণের চিহ্ন নেই কিন্তু প্লেইটলেট দশ হাজার বা তার নিচে৷ তাহলেও প্লেইটলেট দিতে পারেন। সেটা বিশেষ পরিস্থিতি। ডেংগিতে প্লেইটলেট আসলে খুব রেয়ারলি দিতে হয়। আর সিদ্ধান্তটিও নেবে আপনার ডাক্তার৷ ডেংগিতে প্লেইটলেট দেওয়াটা কোন চিকিৎসা না। এটা বারবার দেখবারও কোন প্রয়োজন নেই৷ এটা দেখে রোগের মাত্রাও বুঝা যায়না। প্লেইটলেট পর্যাপ্ত থাকার পরও রোগী খারাপ হতে পারে। মরেও যেতে পারে৷
ডেংগিতে তাহলে মানুষ মারা যায় কেন?
ডিয়ার friends, ডেংগিতে প্লেইটলেট কমে রক্তক্ষরণ হয়ে রোগী মারা যায় ব্যপারটা এমন না। রোগী মারা যায় ডেংগি শক সিন্ড্রোমে। সেটা ভিন্ন বিষয়। এর ম্যানেজমেন্ট ভিন্ন। বিস্তারিত কথা আছে।সব বলতে গেলে সেমিনার হয়ে যাবে। সংক্ষেপে বলি। ডেংগিতে ভাইরাসের কারণে রক্তনালীগুলো আক্রান্ত হয়। রক্তনালীর গায়ে যে ছোট ছোট ছিদ্র থাকে সেগুলো বড় হয়ে যায়। তা দিয়ে রক্তের জলীয় উপাদান বা রক্তরস বের হয়ে আসে। তখন ব্লাড প্রেসার কমতে থাকে। এটা ঠেকাতে রোগীকে ফ্লুইড বা তরল দিতে হবে প্রচুর। মুখে খাওয়ান, শিরাতে দিন। ফ্লুইড, ফ্লুইড এন্ড ফ্লুইড। ঘন ঘন প্লেইটলেট না দেখে ব্লাড প্রেসার কমছে কিনা দেখুন, ডিহাইড্রেশন আছে কিনা দেখুন, রক্তের পিসিভি বা হেমাটোক্রিট দেখুন।হতাশার কথা- এমনকি বড় বড় ডাক্তাররাও এসব গনায় না ধরে ত্রিশ হাজার প্লেইটলেট দেখে ভয়ে আতংকে ছয় ঘন্টা পর পর প্লেইটলেট চেক করে রোগীকে আরো আতংকগ্রস্ত করেন, নিজের চোখখে দেখেছি, প্রেসারের খোঁজও নেননা। হিমাটোক্রিট তো নাই৷ ভাবটা এমন যেন প্লেইটলেট নিরবে নিভৃতে কমে গিয়ে রোগীর হঠাৎ করে হার্ট বন্ধ হয়ে যাবে।
মোদ্দা কথা: ডেংগিতে প্লেইটলেট এর পেছনে অহেতুক সময় নষ্ট না করে রোগীর ফ্লুইড কারেকশন করুন, প্রেসার দেখুন, প্যারাসিটামল খাওয়ান। অযথা এন্টিবায়োটিক আর প্লেইটলেট দেবেননা।
ডাক্তার বন্ধুদের জন্য বলছি ঃ
চিকিৎসা এবং মনিটরিং এর ক্ষেত্রে হেমাটোক্রিট ভ্যালু ও রক্তচাপকে গুরুত্ব দিন। শিরায় নরমাল স্যালাইন দিন। প্লাজমা, ক্রাইওপ্রিসিপিটেট বা ব্লাড প্রোডাক্ট দিয়ে রোগীকে ভারাক্রান্ত করবেন না৷ হিমাটোক্রিট বেড়ে গেলে এবং রোগী শকে গেলে তবেই কলয়েড সলিউশন দেবেন নয়ত নরমাল স্যালাইন। ডেংগির ন্যাশনাল গাইডলাইনটি ফলো করুন। বাংলাদেশে ডেংগি রোগেরা বেশির ভাগ মরে যায় অতিচিকিৎসায়৷
লেখক
ডাঃ গুলজার হোসেন
বিশেষজ্ঞ হেমাটোলজিস্ট
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল
চেম্বারঃ
বি আর বি হাসপাতাল পান্থপথ, ঢাকা।
www.facebook.com/gulzarhematologist