দাঁতের চিকিৎসার খরচ বিষয়ে সর্বাধিক শোনা প্রশ্ন দুটি হলো-
১. দাঁতের চিকিৎসার খরচ এতো বেশী কেনো?
২. বিভিন্ন প্রাইভেট ডেন্টাল চেম্বারে খরচের ভিন্নতা কেনো?
সাধারন মানুষকে সংক্ষেপে খুব সহজে বোঝানোর জন্যে আজ প্রশ্ন দুটির উত্তর দিচ্ছি, ধৈর্য্য ধরে পুরো লেখাটা পড়বার অনুরোধ রইলো।
চিকিৎসকের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতাঃ
পূর্বে চার বছর এবং বর্তমানে পাঁচ বছর পড়াশোনা করে বিডিএস ডিগ্রী অর্জনের পর ইন্টার্ন শেষ করে একজন ডাক্তার প্র্যাকটিস শুরু করেন। নিজে ব্যাক্তিগত চেম্বার দিতে যাবার আগে অতিরিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে শিক্ষক অথবা সিনিয়রদের চেম্বারে বিনা পারিশ্রমিকে অথবা নামমাত্র পারিশ্রমিকে একটা লম্বা সময় কাজ শিখতে হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন ডেন্টাল কলেজে অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ,বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ,হ্যান্ডস অন কোর্স করে নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হয়। এটা হলো নূন্যতম; অনেকে নিজেকে স্পেসিফিক কোনো বিষয়ে আরো দক্ষ করতে কয়েক বছর অক্লান্ত পড়াশোনা+ট্রেনিং করে সে বিষয়ে এফসিপিএস,এমএস,ডিডিএস,পিএইচডি ইত্যাদি পোস্ট-গ্রাজুয়েশন করে থাকেন।
অধিকাংশ রোগীর নিকট দাঁতের চিকিৎসকের পরামর্শ ফি অষ্টম আশ্চর্যের মতো বিষয়। MBBS ডাক্তার পাঁচ মিনিট সময় দিয়ে পাঁচশ-হাজার টাকা পরামর্শ ফি নিলে সমস্যা নেই, BDS ডাক্তার ডেন্টাল চেয়ারে নিয়ে রোগীকে পরীক্ষা করে তারপরে সে অনুযায়ী চিকিৎসা পদ্ধতি বুঝিয়ে পরামর্শ ফি তিনশ-পাঁচশ টাকা চাইলে অনেক রোগীই অবাক হন।
চেম্বার লোকেশন,ভাড়া,ডেকোরেশনঃ
গুলশান/ধানমন্ডি/উত্তরার অভিজাত এলাকার চেয়ে অন্যান্য জায়গায় তুলনামূলক চিকিৎসা খরচ কম। যে চেম্বারের মাসিক ভাড়া বেশী,অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেখানের চিকিৎসা খরচও বেশী। অনেকে চেম্বার ডেকোরেশনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন,সাদামাটা চেম্বারের তুলনায় সেখানে চিকিৎসা খরচ একটু বেশী হওয়াটা স্বাভাবিক।
ডেন্টাল এসিসটেন্ট,রিসিপশনিস্ট,ক্লিনারের বেতনঃ
চেম্বারে প্রয়োজন অনুযায়ী ডেন্টাল এসিসট্যান্ট,রিসিপশনিস্ট এবং ক্লিনার রাখলে মাস শেষে তাদের বেতন ডাক্তারকেই দিতে হবে।
বড় অংকের ব্যাক্তিগত ইনভেস্টমেন্টঃ
ডেন্টাল চেম্বারের জন্যে ডেন্টাল চেয়ার,কম্প্রেসর,এক্স-রে,আইপিএস,জেনারেটর,এসি থেকে শুরু করে প্রচুর ইন্সট্রুমেন্ট কিনতে হয়। এগুলো শুধু দামীই নয়,মেইন্টেইনেন্স খরচও আছে; এবং সবকিছুই নিদৃষ্ট মেয়াদ পার হলে নষ্ট হতে শুরু করে। তাছাড়া ডেন্টালে ব্যাবহৃত ইন্সট্রুমেন্ট,ম্যাটেরিয়ালস প্রায় সবই ইম্পোর্ট করে আনা; তাই এসব কিনতে খরচ অনেক বেশী পড়ে। কেউ আট-দশ লাখ টাকা দামের জাপানিজ-কোরিয়ান ব্র্যান্ডের চেয়ার ব্যাবহার করেন,কেউ দেড়-দুই লাখ টাকার চাইনিজ চেয়ার ব্যাবহার করেন। কেউ দশ-পনেরো হাজার টাকার এন্ডোমটর ব্যাবহার করেন রূট ক্যানেল ট্রিটমেন্ট করতে,কেউ চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকার এন্ডোমটর ব্যাবহার করেন। কারো লাইট কিউর মেশিনের দাম পাঁচ হাজার টাকা,কেউ ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকার লাইট কিউর মেশিন ব্যাবহার করেন। কোনো জিনিসই আজীবনের জন্যে না,কয়েক বছর পার হলে নতুন কিনতে হয়। চিকিৎসকের ইনভেস্টমেন্ট অনুযায়ী চিকিৎসা খরচ কম-বেশী হয়।
জটিল, সূক্ষ এবং সময়সাপেক্ষ চিকিৎসাঃ
ডেন্টালের অধিকাংশ চিকিৎসাই সূক্ষ,তাই নিখুঁতভাবে কাজ করতে হয়। ধৈর্য ধরে মনোযোগ সহকারে দীর্ঘসময় ধরে কাজ করতে হয়। উদাহরণ স্বরুপ এক রুট ক্যানেল চিকিৎসা শেষ করতে ক্ষেত্রবিশেষে তিন-চার দিন সময় লাগে,এবং প্রতি ভিজিটে নূন্যতম আধঘন্টা সময় লাগে। একই সময় ব্যয় করে একজন MBBS ডাক্তার বেশ কয়েকটি অপারেশন সম্পন্ন করতে পারেন এবং বিনিময়ে অনেক বেশী অর্থ উপার্জন করেন। কিন্তু এত দীর্ঘ সময় ব্যয় করে দামী ম্যাটেরিয়ালস খরচ করে,দামী ইন্সট্রুমেন্ট ব্যাবহার করে যদি রুট ক্যানেলের যৌক্তিক খরচ চাওয়া হয়; তাহলে অধিকাংশ রোগীই অবাক হন। লা-মেরিডিয়ানে গিয়ে কেউ মফস্বলের ভাতের দোকানের দামের সাথে তুলনা না করলেও গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারদের কথা বলে অনেকেই প্রাইভেট ডেন্টাল চেম্বারের চিকিৎসা খরচ কমাতে চান। কেএফসি-বিএফসিতে কেউ মুরগী বা আলুর কেজির কথা উল্লেখ করে চিকেন ফ্রাই,ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের খরচ কমাতে না চাইলেও ডেন্টাল চেম্বারে এসে ম্যাটেরিয়াল কস্টের কথা বলে খরচ কমাতে চান।
রোগীর দাঁতের যত্নের প্রতি অসচেতনতা এবং অবহেলাঃ
দাঁতের চিকিৎসার খরচ বেশী হবার পেছনে রোগীরাও অনেকাংশে দায়ী। অধিকাংশ রোগী সমস্যার শুরুতেই চিকিৎসা না করিয়ে ব্যাথার ঔষধ খেয়ে পরে জটিল রুপ ধারন করলে চিকিৎসকের শরনাপন্ন হন। প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করালে খরচ কমে যায়। তাই ছয় মাস অন্তর অন্তর নিয়মিত ডেন্টাল চেকআপ করাতে হবে।
দাঁতের চিকিৎসায় এককালীন ব্যাবহৃত জিনিসঃ
হ্যান্ড গ্লভস,সাকশন টিপস এককালীন ব্যাবহার করা হয়। অন্যান্য যন্ত্রপাতি যেগুলো সরাসরি মুখগহ্বরের সংস্পর্শে আসে সেগুলো অটোক্লেভ,ক্যামিক্যাল স্টেরিলাইজেশন করা হয় যেটা সময়সাপেক্ষ এবং ব্যায়বহুল।
ল্যাবরেটরি বিলঃ
ডেন্টাল ক্রাউন,ব্রিজ,কমপ্লিট ডেনচার,পার্শিয়াল ডেনচার থেকে শুরু করে অনেক কিছুই ল্যাবে তৈরী করা হয়। এসব খরচের একটা বড় অংশ ল্যাবে দিতে হয়।
ইলেকট্রিসিটি বিলঃ
ডেন্টাল চেম্বার ইলেক্ট্রিসিটি বাদে প্রায় সম্পূর্ন অচল। তাই খরচের একটা ভালো অংশ এ খাতে ব্যায় হয়। চেম্বারের লাইট,ফ্যান,ডেন্টাল চেয়ার,কম্প্রেসর,এক্স-রে,এসি,সাইনবোর্ড,আইপিএস,সাকশন মেশিন,লাইট কিউর মেশিন,মাইক্রোমটর,এন্ডোমটর,হ্যান্ডপিস,আইপিএস,অটোক্লেভ,আলট্রা ভায়োলেট স্টোরেজ সব কিছুতে ইলেক্ট্রিসিটি প্রয়োজন।
এত কিছুর পরেও উন্নত বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশের দাঁতের চিকিৎসার খরচ ক্ষেত্র বিশেষে দশ-বিশ ভাগের এক ভাগেরও কম। যাদের আত্মীয়স্বজন বাইরের দেশে থাকেন,তারা অবশ্যই জানেন; আর ইন্টারনেটের কল্যাণে গুগল-ইউটিউব ঘাঁটলেই বিষয়টির সত্যতা যাচাই করতে পারবেন। অনেক প্রবাসী শুধুমাত্র দাঁতের চিকিৎসা করাতে এদেশে আসেন।
সর্বশেষে বলি প্রত্যেক চিকিৎসকই তার পরিবার-পরিজন,আত্মীয়স্বজন, পরিচিত মানুষজন,কাছের মানুষজন থেকে শুরু করে গরীব-অসহায় মানুষদের নামেমাত্র মূল্যে চিকিৎসা করে থাকেন এবং সে সংখ্যা খুব একটা কম না। তাই বলে সবাই যদি নামেমাত্র মূল্যে চিকিৎসা করাকে নিজের অধিকার ভাবেন,তাহলে এ পেশায় টিকে থাকাটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়।
এই লেখকের সব লেখা পড়ুন নিচের লিংক থেকে।
www.royalbangla.com/DrS-MSadique-105600987900812
লেখক
ডা: এস.এম.ছাদিক
বি ডি এস (ডি ইউ)
এম পি এইচ (অন কোর্স)
পি জি টি (ওরাল এন্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারী)
ঢাকা ডেন্টাল কলেজ এন্ড হসপিটাল
লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে নিচের ফেসবুক পেইজে ক্লিক করুন
www.facebook.com/DrS-MSadique-105600987900812