সবে প্যান্ডেমিকের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সাথে একটা অসম লড়াইয়ে একটু একটু করে সামলে উঠতে শুরু করেছে আমাদের দেশ, এমতাবস্থায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে যথা গুজরাট, কর্ণাটক, রাজস্থানে আর একটি জীবাণুকে এপিডেমিক এক্ট এর আওতায় মহামারী ঘোষিত করা হলো। এছাড়াও উত্তরাখন্ড, তেলেঙ্গনা, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, হরিয়ানা, বিহারেও রোজ বাড়ছে এই মারণ ফাঙ্গাসের প্রকোপ। কেন্দ্র থেকে ইতিমধ্যেই প্রত্যেকটি রাজ্যকে অনুরোধ করা হয়েছে, এই ফাঙ্গাসটিকে 'Notifieable Disease' ঘোষণা করতে। এহেন পরিস্থিতিতে আমি মনে করি আমাদের প্রত্যেকের একটা বেসিক ধারণা থাকা উচিত ফাঙ্গাসটির ব্যাপারে। তাই এই লেখা।
কী নাম সেই ফাঙ্গাসের? কী তার ক্ষমতা, কী সিম্পটম, কারা টার্গেট, বাঁচার কী উপায়, ওষুধ কী?
পরিচয়
ফাঙ্গাসটির একধরনের ছত্রাক(mukormycetes) যার দ্বারা মিউকরমাইকোসিস রোগটি হয়। এই ফাঙ্গাস আমাদের এনভায়রেনমেন্টেই মজুত আছে।
কীভাবে শরীরে প্রবেশ করে?
বাতাসে ভেসে থাকা এই ফাঙ্গাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে আমাদের নাক, সাইনাস এবং লাংস এর মাধ্যমে। এ ছাড়াও শরীরের কোনও কাটা বা পোড়া অংশ থাকলে সেখান দিয়েও শরীরের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে। যদি এই ফাঙ্গাস শরীরের কোনও কাটা বা পোড়া অংশ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে তবে লোকাল ইনফেকশন হয়। চিন্তার ব্যাপার নয় সেটা। কিন্তু যদি এই ফাঙ্গাস আমাদের শরীরে সাইনাস এর মাধ্যমে ঢোকে তবে তা ধীরে ধীরে প্রভাব ফেলে চোখে এবং ব্রেনে। ব্রেনে পৌঁছানোর পর এই ফাঙ্গাস মারাত্মক ভয়ানক রূপ ধারণ করে। তাছাড়াও এটি নাক দিয়ে ঢুকে ফুসফুসে প্রবেশ করলে পালমোনারী মিউকরমাইকোসিস তৈরি করে।
কেন হঠাৎ এই ফাঙ্গাস মারণ রূপ ধারণ করলো?
Aiims এর ডিরেক্টর রণদীপ গুলেরিয়ার মতে, এই কোভিড সিচ্যুয়েশনে স্টেরয়েডের যথেচ্ছ ব্যবহার, স্বস্তা স্টেরয়েডের ব্যবহার, সুগার লেবেলের যথেচ্ছ বাড়বাড়ন্ত, অক্সিজেন সিলিন্ডারের ফ্লো মিটারে অর্ডিনারী ট্যাপ ওয়াটারের ব্যবহার ইত্যাদি। এছাড়াও কোভিড পেশেন্টদের ইমিউনিটি কমে যাওয়ায় তাদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা দিচ্ছে।
সিম্পটম কী?
ICMR এর মতে প্রাথমিক লক্ষ্মণ গুলো হলো সাইনাস পেন, একদিকের নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, মাথার একটা নির্দিষ্ট দিক যন্ত্রণা করা, দাঁতের যন্ত্রণা, দাঁত পড়ে যাওয়া। বড়ো বড়ো নার্সিংহোমগুলো জানাচ্ছে রুগীদের মধ্যে ঝাপসা দৃষ্টি, নাকের টিস্যু ডিস কালার হয়ে যাওয়া বা কালো হয়ে যাওয়া, মুখের ভিতর ব্ল্যাক লেসন ইত্যাদির লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া জ্বর ও থাকছে সাথে।
টার্গেট কারা?
6 বছর বয়সের নিচের বাচ্চা,ডায়াবিটিস রুগী, সদ্য কোভিড থেকে সেরে ওঠা রুগী বা সেরে উঠছে, সঙ্গে (Immunocompromised eg steroids, stress or medicine induced hyperglycemia, cancer , lymphoma, Transplant patients, chronic diseases on immunosuppresants , cirrhosis liver patients , long duration ICU admitted patients) এমন রুগীরা ভীষণ সফ্ট টার্গেট। আপনার ডায়াবিটিস থাকলে, তা কন্ট্রোলে রাখুন। আর অন্য কোনও উপায় নেই সতর্ক হওয়ার।
ডায়াগনোসিস-
টিস্যু বায়োপসি,সিটি স্ক্যান করলে রোগটি ধরা পড়তে পারে।
চিকিৎসা কী?
শরীরে প্রবেশ করার পর এই ফাঙ্গাস নাকের মাধ্যমে চোখে প্রবেশ করে। তারপর ব্রেনে এট্যাক করে। ব্রেনে পৌঁছানোর পরেই এই ফাঙ্গাস মারণ রূপ নেয়। এই সময়ে আপনার প্রয়োজন এক্সপার্ট এর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ফাঙ্গাস প্রাথমিক স্টেজে ধরা না পড়লে শরীরের বিভিন্ন পার্টের ক্ষতি সাধন করছে ফাঙ্গাসটি। শরীরের যে সমস্ত জায়গায় ফাঙ্গাসটা ছড়িয়ে পড়বে সেইসমস্ত জায়গা সার্জিক্যালি রিমুভ করতে হবে। কিছু রুগী নিজেদের চোখ হারিয়েছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্যান্য অঙ্গহানি।
কতটা রিস্কি?
ফ্যাটালিটি রেট ভীষণই হাই। Mortality রেট প্রায় ৮০ শতাংশ যদি রুগীর সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হয়। চিকিৎসা হলেও এই রেট ৪০-৫০ শতাংশ। ডাক্তারদের মতে এই ফাঙ্গাসের বিরুদ্ধে চিকিৎসার সময় যে ড্রাগ ব্যবহার করা হয় তা ভবিষ্যতে কিডনি ড্যামেজ, নিউরোলজিকাল ডিসফাংশন এবং স্ট্রোক এর সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
চিকিৎসার জন্য কোন ওষুধ ব্যবহার করা হয়?
আপাতত ডাক্তাররা Lipsomal Amphotericin B ব্যবহার করছেন ব্ল্যাক ফাঙ্গাস এর বিরুদ্ধে। প্রায় ২০টা ভায়াল এর প্রয়োজন একজন রুগীর রোগ নিরাময় করতে। প্রত্যেকটা ভায়াল এর দাম প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। আপাতত বাজারে এই ওষুধের এভেলেবিলিটির অবস্থা সঙ্কটজনক। এছাড়াও posaconazole ও isavuconazole ব্যাবহার করা হচ্ছে।মনে রাখবেন এই রোগের ক্ষেত্রে সেল্ফ মেডিকেশন অত্যন্ত বিপদজনক এবং যে কোনও ওষুধের ব্যবহার ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করার পরেই করতে হবে।
সুরক্ষাবিধি-
১. পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকুন।
২.ফুল হাতা জামা প্যান্ট পরে গার্ডেনিং,ঘর পরিষ্কার করুন।
৩. মাস্ক পরুন।
৪.কোথাও কেটে বা পুড়ে গেলে সাবান জল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিন।
৫.নোংরা,ধুলোময় জায়গা দিয়ে যাতায়াত এড়িয়ে চলুন।
৬.বাগানে কাজ করার সময় পায়ে জুতো এবং হাতে গ্লাভস ব্যবহার করুন।
৭.হাতে পায়ের নখ কেটে পরিষ্কার রাখুন।
৮.সর্বোপরি সচেতন হোন। সচেতনতা ছাড়া এই রোগ থেকে আমরা বাঁচতে পারবো না।
সোর্স - সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা: সমুদ্র সেনগুপ্ত, নন্দীগ্রাম স্বাস্থ্য জেলা, পূর্ব মেদিনীপুর, লেখা নিচের প্রবন্ধটি যুক্ত করলাম।।
প্ৰ: এই মিউকরমাইকোসিস রোগটা ঠিক কি ?
উঃ এটি পরিবেশে বসবাসকারী একটি ছত্রাক জনিত রোগ। সাধারণত আমরা এতে আক্রান্ত হই না। অন্য কোনো অসুখের জন্য চিকিৎসা নিচ্ছেন এমন কিছু রোগীর দেহে যখন পরিবেশে ছড়িয়ে থাকা নানান রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় তখন তার দেহে এই ছত্রাক বাসা বাঁধতে পারে।
রোগটির প্রাদুর্ভাব তেমন নয় বলে আমরা পরিচিত নই। কিন্তু এটি একটি গুরুতর অসুখ। এর রোগলক্ষণ ও উপসর্গগুলি হ'ল:-
• চোখ বা নাকের পাশে ব্যাথা ও লাল হয়ে যাওয়া
• জ্বর,
• মাথায় যন্ত্রনা,
• কাশি,
• নিঃশ্বাসের কষ্ট,
• রক্তবমি,
• মানসিক অবস্থার পরিবর্তন।
প্ৰ: কি কি কারণে এই ছত্রাক আমাদের দেহে বাসা বাঁধতে পারে ?
উঃ যে যে অবস্থায় এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় সেগুলো হ'ল:
• অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রোগ;
• স্টেরয়েড ব্যবহারের ফলে ইমিউনোসাপ্রেসন বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দমে যাওয়া;
• ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে দীর্ঘদিন ভর্তি থাকা;
• অঙ্গ প্রতিস্থাপন এর পরে/ ক্যানসার জাতীয় কো মর্বিডিটি;
• ভরিকোনাজল থেরাপি
প্র: এই রোগে আক্রান্ত হওয়া আটকানো যায় কি ভাবে ?
উঃ সাধারণ নাগরিক যা যা করতে পারেন:-
• ডায়াবেটিস রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে নিয়মিত ব্লাড সুগার মাপা ও ওষুধ নেওয়ার মাধ্যমে।
• সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। মাস্ক ব্যবহার এর ক্ষেত্রে কোনো শিথিলতা মেনে নেওয়া যাবে না বিশেষ করে নির্মাণ কাজ এর এলাকায়।
• সার-মাটি ইত্যাদি ব্যবহার করে বাগান করা জাতীয় কাজের সময় ফুল প্যান্ট, ফুল হাতা জামা, ঢাকা জুতো, গ্লাভস দস্তানা ব্যবহার করা দরকার।
• ব্যক্তিগত হাইজিন বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, ঘষে ঘষে ময়লা পরিষ্কার করে স্নান করতে হবে।
• আশেপাশের পরিবেশকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এমনভাবে যে যাতে কোনোমতেই পচে যাওয়া অর্গানিক জৈব পদার্থ যেমন পাউরুটির টুকরো, ফল, শাকসবজি, কম্পোস্ট, মলমূত্র ইত্যাদির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা যায়।
স্বাস্থ্যকর্মী/ চিকিৎসকরা যা যা করতে পারেন:-
• স্টেরয়েড ব্যবহার যাতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা। সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় সঠিক দিন ধরে ব্যবহার করা;
• অক্সিজেন থেরাপির সময় হিউমিডিফায়ার বোতলে ডিস্টিলড বা পরিশ্রুত জল ব্যবহার করা।
প্র: কখন সন্দেহ জাগবে যে এই রোগ হয়েছে ? (কোভিভ রুগী যাদের ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত/ ইমিউনো সাপ্রেসড মানুষজন): মূলতঃ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য
উঃ ওই রোগ লক্ষণগুলি হল:-
• সাইনুসাইটিস- নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, নাক থেকে কালো/ লালচে ক্ষরণ, হনুর হাড়ের ওপর ব্যথা।
• মুখের এক পাশে ব্যথা, অসাড় হয়ে যাওয়া, ফুলে ওঠা, মুখের ভেতর তালুতে/ নাকের গোড়ায় কালচে ভাব।
• দাঁতে ব্যথা, দাঁত আলগা হয়ে আসা
• চোখে ব্যথা, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা, দুটো করে দেখা
• জ্বর, ত্বকে দাগ- এসচার
• বুকে ব্যথা, ফুসফুসের আচ্ছাদনে জল জমা, রক্ত-কাশি, শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা উপসর্গ বেড়ে যাওয়া
সংযোজন: কেবলমাত্র স্বাস্থ্যকর্মী/চিকিৎসকদের জন্য:-
প্র: স্বাস্থ্যকর্মী/ চিকিৎসক হিসেবে কি করনীয়?
উঃ যা করবেন-
• পোস্ট কোভিভ ও ডায়াবেটিকদের ব্লাড গ্লুকোজ এর মাত্রা মনিটর করা;
• বিপদ সঙ্কেত চিহ্নিত করার জন্য নিয়মিত চেকআপ;
• নিয়মনিষ্ঠভাবে এন্টিবায়টিক/ এন্টিফাঙ্গালের ব্যবহার।
যা করবেন না-
• নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া সব রুগীকে, বিশেষত কোভিভ রুগী/ ইমিউনো সাপ্রেসডদের সাইনুসাইটিস কে ব্যাকটেরিয়া জনিত বলে বিবেচনা করবেন না।
• ছত্রাক এর রকমসকম জানার জন্য জোরকদমে ইনভেস্টিগেশন করতে (KOH স্টেনিং, মাইক্রোস্কোপি, কালচার) ইতস্ততঃ করবেন না।
• মিউকর মাইকোসিস এর চিকিৎসা শুরু করতে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না।
যে ব্যবস্থাগুলি নেবেন-
• ডায়াবেটিস ও ডায়াবেটিক কিটোএসিডসিস এর কঠোর নিয়ন্ত্রণ;
• ঝপ করে স্টেরয়েড বন্ধ করে দেওয়ার লক্ষে ওর মাত্রা কমিয়ে আনা;
• ইমিউনো মডুলেটোর ড্রাগ এর ব্যবহার বন্ধ করা;
• প্রোফাইল্যাক্সিস হিসেবে এন্টিফাঙ্গাল ব্যবহার করার দরকার নেই আগেভাগে;
• সার্জিক্যাল ডিব্রাইডমেন্ট বা শল্যচিকিৎসা করে সমস্ত নেক্রোটিক টিস্যু চেঁছে বাদ দেওয়া;
• এমফটেরিসিন বি ব্যবহার করে মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট;
• সেন্ট্রাল ক্যাথেটার (PICC line) লাগানো
• কমপক্ষে চার থেকে ছয় সপ্তাহ এন্টিফাঙ্গাল ব্যবহার;
• রোগীকে নিয়মিতভাবে ক্লিনিক্যাল ও রেডিও ইমেজ এর মাধ্যমে মনিটর
কোভিভ রুগী মানেই সে এই রোগে আক্রান্ত হবে এমনটা নয়। সাবধানতা নিলে এর সম্ভাবনা প্রায় নেই। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নিলে রুগী সেরে উঠবে।
[সূত্রঃ প ব সরকার স্বাস্থ্য দপ্তরের নির্দেশিকা ২১শে মে, ২০২১]
পুষ্টিবিদ মোঃ ইকবাল হোসেন
চেম্বারঃ
সার্জিস্কোপ হাসপাতাল, ইউনিট-২, কাতালগঞ্জ, চট্টগ্রাম। প্রতি শুক্রবার থেকে বুধবার, সন্ধ্যা ৭ঃ০০ টা থেকে রাত ১০ঃ০০ টা পর্যন্ত।
সিরিয়ালের জন্যঃ ০১৭৬৪-৭৮৬৭৫৩
অনলাইন সেবা পাওয়ার জন্য
হোয়াটস এ্যাপ নম্বর-01533843123
লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে নিচের ফেসবুক পেইজে ক্লিক করুন
www.facebook.com/Nutritionist.Iqbal