অনেকের ই বিভিন্ন পরিস্থিতিতে পড়লে মনে হয় দম আটকে যাচ্ছে , শ্বাস নিতে পারছেন না , পালপিটেশন বেড়ে যাচ্ছে ,আতঙ্ক লাগছে , এখনই মরে যাচ্ছেন এমন ফিল হয়। এটাকে ইংরেজিতে প্যানিক এটাক বলে।
প্যানিক এটাকের যথাযথ চিকিৎসা করা না হলে এটি প্যানিক ডিসর্ডারের দিকে ধাবিত করে এবং অন্যান্য জটিলতাও সৃষ্টি করতে পারে। এর কারণে এমনকি একজনের দেহের সাধারণ কার্যাবলিও থমকে যেতে পারে। কিন্তু যদি দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া হয় তাহলে প্যানিক এটাক সমস্যাটি দূর হয়ে যেতে পারে অথবা এর প্রকোপ কমানো যেতে পারে এবং পরবর্তীতে একজন সাধারণ জীবনযাপনও করতে পারেন।
প্যানিক এটাকের লক্ষণঃ
১. সারাক্ষণ গলা থেকে বুকের মাঝ বরাবর আর পেটের অর্ধেক পর্যন্ত একটা তীব্র আতঙ্ক চেপে ধরে আছে। মনে হচ্ছে ভয়ে আর আতঙ্কে কচলাচ্ছে।
২. নিশ্বাস নিতে কস্ট হচ্ছে, গলা চেপে ধরে আছে, বুকটাও চেপে ধরে আছে। মনে হচ্ছে এক্ষুণি মারা যাবো।
৩. বুকের মাঝখানটা চেপে ধরে শ্বাস কস্ট ভয় লাগে, তখন হার্টবিট বেড়ে যায় মনে হয় হার্ট এটাক হচ্ছে নইলে স্ট্রোক হচ্ছে, এখন বুঝি নিশ্চিত মৃত্যু। নিজেকে কোন কথা বলেও বুঝানো যায় না শান্ত করা যায় না।
৪. হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। এতই দুর্বল লাগে যে মনে হয় আমি মাথা ঘুড়ে পড়ে যাবো।
৫. নামাজ পড়তে ভয় লাগে মৃত্যুর চিন্তা বেশি আসে, মসজিদে গেলে ভয় আরো বেশি ভয় লাগে। কুরআন শরিফ পড়লে পরকালের কথা মাথায় আসে বলেই আরো বেশি ভয় লাগে .
৬. হাত, পা কাঁপে , ঠোঁট কাঁপে , কান্না পায়।
প্যানিক এটাক কারো জীবনে কখনো হয়তো এক-দুইবার ঘটে থাকে। কিন্তু এমন কিছু মানুষ আছে যাদের কিছু দিন পরপরই প্যানিক এটাক হয়।
প্রথমত আপনি যদি প্যানিক এটাকে আক্রান্ত হোন প্রথমে কি করবেন?
প্যানিক এটাক মূল কারণ এখনও জানা যায়নি তবে এতো বছরের গবেষণা থেকে জানা যায় যে, প্যানিক ডিজঅর্ডার শরীরবৃত্তীয়, পরিবেশগত উভয় কারণের সংমিশ্রণ।
পাশাপাশি বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক নিয়ামক, যেমন- জীবনে জটিলতা, কোনো বিষাদময় ঘটনা, আর্থিক সমস্যা, অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, বিভিন্ন প্রকার ফোবিয়া থেকে প্যানিক ডিসঅর্ডারের সূচনা ঘটতে পারে। পরিবারে কারও এই রোগ থাকলে অন্যদের তুলনায় ৪-৮ গুণ বেশি হবার সম্ভাবনা থাকে।
এছাড়া হাইপারথাইরয়েডিজম, হাইপোগ্লাইসিমিয়া, মাইট্রাল ভালভ প্রলাপস ইত্যাদি রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় প্যানিক ডিসঅর্ডার হতে পারে।
পরিবারে বাবা-মা কারও যদি প্যানিক ডিজঅর্ডার থেকে থাকে বা হৃদরোগ থেকে থাকে তাহলে সন্তানদেরও এটা হতে পারে।
মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ এলাকায় অস্বাভাবিকতা থাকলে। মস্তিষ্কের ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স এরিয়া নিয়ন্ত্রণকারী অংশে সমস্যা থাকলে প্যানিক ডিজঅর্ডার হতে পারে।
নিয়ন্ত্রণ বিধি ও চিকিৎসা ব্যবস্থাঃ
প্যানিক ডিসঅর্ডারের অভিজ্ঞতা প্রথমবারের মতো হলে অনেকই বিশ্বাস করেন যে তাদের হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে।প্যানিক ডিসঅর্ডারের ব্যাধি একবার নির্মূল করা সম্ভব নাও হতে পারে।কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করলে এই রোগ নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব।
অ্যালকোহল এবং উত্তেজক যেমন ক্যাফিনের পাশাপাশি অবৈধ ড্রাগগুলি এড়িয়ে চলতে হবে।
এই প্যানিক ডিসঅর্ডারের জন্য ওষুধ প্রয়োগে চিকিৎসা করা হয় এবং সাথে সাথে কিছু মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসাও করা হয়।যেমন —
নিজেকে শান্ত করা : নিজেকে শান্ত করে মনের ভ্রান্ত ভয় ও আতঙ্ক ধারণা দূর করার চেষ্টা করা । নিজেকে এটা বোঝানো যে এটি একটি সাময়িক অবস্থা যা সহজেই ঠিক হয়ে যাবে, এতে মৃত্যুর সম্ভাবনা নেই।
শেয়ার করা : কারো সাথে নিজের প্রবলেম তা শেয়ার করা। এতে হালকা বোধ হয় , নিজের যুক্তি , চেতনা ও ফিরে আসে। Relaxation Trainingঃ রোগীকে শেখাতে হয় যে প্যানিক অ্যাটাকের সময় কীভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণে আনা: প্যানিক অ্যাটাকের সময় বড় বড় করে বুক ভরে শ্বাস নিন। এতে মানসিক স্থিরতা আসবে । ধিরে ধিরে এট্যাক ও নিয়ন্ত্রনে আনা যাবে।
প্র্যাকটিস: যাদের এই সমস্যা বেশি হয় তারা আগে থেকে যদি নিজেকে ট্রেনিং দিয়ে রাখেন যে কেমন বোধ করলে কি করতে হবে। কোনটা করলে মন শান্ত হবে, তাহলে নেক্সট এট্যাক সহজে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।
প্যানিক অ্যাটাকের লক্ষণগুলো কমিয়ে আনতে প্রথমেই স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট করতে হবে । যেমন —
- অতিরিক্ত ক্যাফেইন জাতীয় খাবার যেমন কফি, চা , কোলা ও চকলেট খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
-যেকোনো ওষুধ বা হারবাল প্রতিষেধক ব্যবহারের আগে ডাক্তারের পরামর্শ অবশ্যই নিতে হবে। কারণ, অনেক ওষুধে অ্যাংজাইটি লক্ষণ উদ্রেককারী কেমিকেল থাকে।
-হালকা ব্যয়াম করে নিলেও মন অন্য দিকে সরে যায়। নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণ আসে।
-যখন মনে হবে এই ধরণের পরিস্থিতি তৈরি হতে চলেছে তখন প্রথমেই মুখে চোখে বারবার ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা দেওয়া দরকার। সাথে আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা পানি পান করাও দরকার।
-দীর্ঘ ও ধীরে (deep breathing) শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। এতে নিঃশ্বাসের কষ্ট দূর হতে সাহায্য হয়।যে মুহূর্তে মনে হবে প্যানিক শুরু হচ্ছে সাথে সাথে উচিত মনকে অন্যদিকে ব্যস্ত করে ফেলার। গান শোনা, গল্প করা, পড়া বা যা ইচ্ছা লিখতে শুরু করা। এগুলো মনকে অন্যমনস্ক করে ফেলে। ফলে প্যানিক অ্যাটাক হওয়ার যে ট্রিগারটি সক্রিয় হচ্ছিল তা নিস্ক্রিয় হয়ে যায়।
সবশেষে বলব যাদের এমন সমস্যা হয় তাদের কষ্টকে অদ্ভুত ভেবে ছোট না করে,মজা না করে মানবিকতার খাতিরে তাঁর পাশে থাকার চেষ্টা করা আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য। যে ঘটনা বা পরিস্থিতিতে রুগীর এই অবস্থার শিকার হচ্ছেন সেই পরিস্থিতি, ঘটনা বা কথা বা ব্যবহার এড়িয়ে চলাই উচিত।মানসিক যে কোনো রোগের যন্ত্রণা এমন এক বিশেষ প্রকারের যন্ত্রণা যা বাইরে থেকে দেখে বোঝা বা অনুভব করা সম্ভব নয়। এমনকি যার সমস্যা হচ্ছে সে বারবার বললেও তা যেহেতু চোখে দেখা যায়না তাই অন্যের পক্ষে বোঝা সহজে সম্ভব হয়না। তাই এসব ক্ষেত্রে শুধু অই ব্যাক্তির কথাগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাঁর সুবিধা ও অসুবিধাগুলোকে একটু গুরুত্ব দিতে হবে। যে কোনও মানসিক কষ্টে সবথেকে বেশি দরকার সহমর্মিতা।
লেখক
Dr.Afjal Hossain
Telemedicine Service
Assistant Registrar
United Hospital, Gulshan 2,Dhaka.
Former Panel Physician USA Embassy
Internship Mitford Hospital, Dhaka.,Dhaka.
Studied Sir Salimullah Medical College, Dhaka.
লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে নিচের ফেসবুক পেইজে ক্লিক করুন
www.facebook.com/drafjalhossain