মহিলাদের প্রজননতন্ত্রের অন্যতম হল ডিম্বাশয় যা ডিম্বাণু (ঋতুস্রাবের সময়ে ডিম্বানু বিমুক্ত করে) উৎপাদনে সাহায্য করে। ডিম্বাশয়ের মধ্যে ছোট ছোট গ্রন্থি থাকে যেগুলি ঋতুস্রাবকালীন সময়ে উৎপন্ন হয় এবং ডিম্বানু মুক্ত করে শরীরের সঙ্গে মিশে যায়। যখন ডিম্বাশয়ের মধ্যে কোনও গ্রন্থি ডিম্বানু মুক্ত না করে বা ডিম্বানু মুক্ত করার পর মিশে না যায় বা দুটিই হয় তখন ওভারিয়ান সিস্ট গঠন হয়। ফলে, গ্রন্থিটি তরল পদার্থ ভর্তি বুদবুদের মতো ফুলে ওঠে। মহিলাদের মধ্যে ওভারিয়ান সিস্ট গঠন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা এবং তার কোনও উপসর্গ নাও দেখা যেতে পারে, অর্থাৎ দীর্ঘদিন উপসর্গহীন অবস্থায় থাকতে পারে। এই অবস্থার সাধারণ ইঙ্গিত হচ্ছে তলপেটে ব্যাথা, অনিয়মিত ঋতুস্রাব, এবং আকস্মিক ওজন বেড়ে যাওয়া। । মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত হয় অনিমিত হরমোন নিঃসরণ। অন্যান্য কারণ স্বাস্থ্যের অবস্থার মধ্যে নিহিত থাকে, যেমন ফাইব্রয়েড বা এন্ডোমেট্রিওসিস, যা একজন মহিলার ওভারিয়ান সিস্ট গঠনের পক্ষে অনুকূল অবস্থা। এই সিস্টগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আলট্রাসাউন্ড স্ক্যানের সাহায্যে নির্ণয় এবং নিরাময় করা যায়। বহু ক্ষেত্রে সিস্ট কয়েকমাসের মধ্যে নিরাময় হয়ে যায়, এবং কোনও চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। তবে বিরল ক্ষেত্রে এই সিস্টগুলি ক্যান্সারপ্রবণ হতে পারে। ওভারিয়ান সিস্ট-এর চিকিৎসায় হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে গর্ভ নিরোধক বড়ি ব্যবহার করা হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের সাহায্যে সিস্ট অপসারণের প্রয়োজন হতে পারে। তাতে সাধারণত ফল ভাল হয়। চিকিৎসা না করে ফেলে রেখে দিলে ওভারিয়ান সিস্ট থেকে বন্ধ্যাত্ব হতে পারে।
ওভারিয়ান সিস্ট এর উপসর্গ - সক্রিয় বা ফাংশনাল সিস্টের সাধারণত কোনও উপসর্গ থাকে না। তবে অস্বাভাবিক বা প্যাথলজিক্যাল সিস্টের ক্ষেত্রে যে সমস্ত উপসর্গ দেখা যায় তার মধ্যে আছে
- তলপেটে ব্যাথা, তা তীব্র বা মন্দমন্দ হতে পারে।
- ফুলে ওঠা (ব্লোটিং)।
- বমিভাব।
- বমি করা।
- ক্ষুধামান্দ্য।
- পেট কষে যাওয়া (কনস্টিপেশন)।
- অনিয়মিত ঋতুস্রাব।
- তলপেট ফুলে ওঠা এবং নরম বা টেন্ডার হওয়া।
ওভারিয়ান সিস্ট-এর অপেক্ষাকৃত কম উপসর্গের মধ্যে আছে:
- শ্রোণিদেশে যন্ত্রণা।
- শারীরিক মিলনের সময় যন্ত্রণা।
- ব্যাখ্যাবিহীন যোনিতে রক্তক্ষরণ।
- স্তনে হাল্কা ব্যাথা বা টেন্ডারনেস। (আরও পড়ুন - স্তনে ব্যাথার কারণ)
- বারবার প্রস্রাব।
- উরুতে এবং পিঠের নিম্নপ্রদেশে ব্যাথা।
- হঠাৎ ওজনবৃদ্ধি ।
- যদিও ওভারিয়ান সিস্ট-এর কারণে বেশিরভাগ মহিলার সন্তান উৎপাদন বাধাপ্রাপ্ত হয় না, কিছু মহিলার প্রসূতি হওয়া সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
ওভারিয়ান সিস্ট এর চিকিৎসা -অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওভারিয়ান সিস্ট কয়েক মাসের মধ্যে বিনা চিকিৎসায় নিরাময় হয়। এই সব ক্ষেত্রে কোনও উপসর্গ দেখা যায় না।
যে সব কারণে থেরাপি বা চিকিৎসার প্রয়োজন হবে:
- সিস্টের আয়তন।
- তা থেকে কী উপসর্গ হচ্ছে।
- মহিলার ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গিয়েছে কিনা।
- কিছুদিন ধরে সিস্ট পর্যবেক্ষণ
অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিকিৎসক পরামর্শ দিতে পারেন, আপনি অবিলম্বে কোনওরকম চিকিৎসার মধ্যে না গিয়ে শুধুমাত্র শারীরিক পরীক্ষা, যেমন আলট্রাসাউন্ড, করে দেখতে থাকুন সিস্ট নিরাময় হয়ে যাচ্ছে কিনা। যে সব মহিলার ঋতুচক্রকালীন ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গিয়েছে, তাঁদের চারমাস অন্তর অন্তত এক বছর আলট্রাসাউন্ড স্ক্যান করার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে, কারণ তাঁদের ডিম্বাশয়ে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি।যদি আলট্রাসাউন্ড করে দেখা যায় সিস্ট আর নেই, তাহলে আর কোনও চিকিৎসার প্রয়োজন পড়বে না।
চিকিৎসা
স্বাস্থ্য পরিষেবাকারীরা ডিম্বাণু উৎপাদন রোধে হরমোনের চিকিৎসার (জন্মনিরোধক পিল ) পরামর্শ দিতে পারেন। তার ফলে সক্রিয় বা ফাংশনাল সিস্ট গঠনে বাধার সৃষ্টি হবে।
অস্ত্রোপচার
বড় আকারের সিস্ট, যা থেকে ব্যাথা এবং বড় হয়ে ওঠা বা ফুলে ওঠা জাতীয় উপসর্গ দেখা দেয়, তা অস্ত্রোপচার করে বাদ দিতে হতে পারে। অস্ত্রোপচার দু’টি ভিন্ন উপায়ে করা যেতে পারে:
ল্যাপারোস্কোপি
ছোট আকারের সিস্ট, যা ক্যান্সারপ্রবণ হয় না, তা ল্যাপারোস্কোপি পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচার করে বাদ দেওয়া যেতে পারে। এই অস্ত্রোপচারে পেটের নাভিকুণ্ডলে একটি ক্ষুদ্র ছিদ্র করে সেখান দিয়ে একটি যন্ত্র ঢুকিয়ে তার সাহায্যে সিস্টটি বার করা হয়।
ল্যাপারোটমি
যে সব সিস্টের থেকে ক্যান্সার হতে পারে সেগুলি আকারে বড় হয় এবং ল্যাপারোটমি পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচার করে বাদ দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচার করা হলে চিকিৎসক সিস্টটি ক্যান্সারপ্রবণ কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় পাঠাতে পারেন। যদি দেখা যায় সিস্টটি ক্যান্সারপ্রবণ তাহলে একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ (অঙ্কোলজিস্ট) পরবর্তী চিকিৎসার জন্য পরামর্শ দেবেন। সংক্রমণের তীব্রতা বুঝে চিকিৎসক ডিম্বাশয়ের অপসারণ প্রয়োজন হতে পারে।
অস্ত্রোপচারের পর আপনি পাকস্থলী এবং আশেপাশের এলাকায় অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারেন। তবে অস্ত্রোপচার দরুন ব্যাথা কয়েকদিনের মধ্যে কমে যাবে। ল্যাপারোস্কোপিতে নিরাময়ের সময়কাল দু’সপ্তাহ, ল্যাপারোটমির ক্ষেত্রে এই সময়কাল আট সপ্তাহ হতে পারে।
ওভারিয়ান সিস্ট সামলাতে কয়েকটি পদক্ষেপ খুব কাজের হতে পারে। এগুলির মধ্যে স্বাস্থ্যরক্ষার একটি তালিকা আছে যা থেকে জানা যাবে 'কী করবেন' আর 'কী করবেন না':
ধূমপান ত্যাগ করুন
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যে সব মহিলা ধূমপান করেন তাঁদের বেশি ওভারিয়ান সিস্ট গঠন হয়ে থাকে। কাজেই যে কোনও মূল্যে অতিরিক্ত ধূমপান এবং মদ্যপান থেকে বিরত থাকা উচিত।
ক্যাফিন গ্রহণ সীমিত করুন
ক্যাফিনের কারণে ওভারিয়ান সিস্ট গঠন বাড়ে। কাজেই ক্যাফিন গ্রহণ সীমিত করুন।
চিনি খাওয়া কমান
অতিরিক্ত চিনি খেলে ফোলা এবং প্রদাহ বাড়বে। যদি আপনি সিস্ট থেকে ইতিমধ্যেই কষ্ট পাচ্ছেন তাহলে চিনি এবং অন্যান্য পরিশ্রুত কার্বোহাইড্রেটের কারণে ব্যাথা বাড়বে। কাজেই, চিনি খাওয়া সীমিত করতে হবে। প্রক্ররণজাত খাদ্যও এড়িয়ে চলতে হবে।
ইস্ট্রোজেন গ্রহণ সীমিত করুন
খাদ্যের উৎস যেমন সয়া এবং খাদ্যে সংযোজিত (অ্যাডিটিভ)পদার্থে বহুল পরিমাণে ইস্ট্রোজেন এবং জেনোইস্ট্রোজেন আছে। শরীরে অতিরিক্ত ইস্ট্রোজেন মাত্রার উপস্থিতি হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত করতে পারে, যা থেকে আবার ওভারিয়ান সিস্ট হতে পারে
স্টেরয়েড ওষুধ এড়িয়ে চলুন
স্টেরয়েড ওষুধ থেকে হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়, যা থেকে আবার ওভারিয়ান সিস্ট হতে পারে, আর সেই কারণে এড়িয়ে চলা উচিত। যন্ত্রণা কমানোর জন্য, ব্যাথা নিরোধক ওষুধের পরিবর্তে প্যারাসিটামল গ্রহণ করা ভাল।
সুষম খাদ্য খান
যদি এখনই আপনার ওভারিয়ান সিস্ট হয়ে থাকে তাহলে আপনাকে স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাদ্য খাওয়ার বিষয়ে বিশেষ যত্ন নিতে হবে। ফের যাতে সিস্ট গঠন না হয় তার জনা আপনার খাদ্যের মধ্যে অবশ্যই থাকতে হবে ফল, সবজি, শস্য। এই খাদ্যবস্তুগুলি তন্তুসমৃদ্ধ, যা প্রাকৃতিক উপায়ে সিস্ট নিরাময়ে সাহায্য করে এবং বারবার সিস্ট গঠনের পথে বাধার সৃষ্টি করে।
ব্যায়ামের জন্য নির্দিষ্ট সময়
যোগাভ্যাস করলে এবং অন্যান্য স্ট্রেচিং ব্যায়াম করলে শুধু ওভারিয়ান সিস্ট নিরাময়ে সাহায্য হবে না, ঋতুস্রাবের অসুবিধাগুলিও, যেমন ঋতুস্রাবের যন্ত্রণা এবং পেটে এবং পিঠে খিল ধরা কমে যাবে। নিয়মিত ব্যয়াম করলে মানসিল চাপের মাত্রাও কমে যাবে এবং ওভারিয়ান সিস্ট কমে জাওয়ার কারণে সারা শরীরে আরাম বোধ হবে।
ঋতুস্রাবের সাময় আরামদায়ক কাপড় পরুন
ঋতুস্রাবের সময় টাইট এবং অস্বচ্ছন্দ কাপড়জামা পরলে আপনার তলপেটে চাপ পড়বে এবং ব্যাথা বাড়বে। সেই কারণেই আরামদায়ক এবং ঢিলেঢালা পোশাক পরা বাঞ্ছনীয়।
প্রচুর জল খান
দিনে 7-8 গ্লাস জল খেলে শরীর থেকে যাবতীয় টক্সিন বার হয়ে যাবে এবং প্রদাহ কমবে। অতএব শরীরে যেন জল কম না হয়।
বিশ্রাম নেওয়ার কৌশল
মানসিক চাপ এবং দুশ্চিন্তা- র কারণে হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে বলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। সক্রিয় বা ফাংশনাল সিস্টের অন্যতম স্বাভাবিক কারণ হল মানসিক চাপ। এই কারণে, নিরুদ্বেগ জীবনের জন্য যে সব কৌশল অবলম্বন করতে হবে তার মধ্যে আছে গভীরভাবে শ্বাস নেওয়া, ধ্যান করা, ব্যায়াম করা, বা কোনও থেরাপি করানো, যাতে শরীর এবং মন একটি ভারসাম্যের অবস্থানে থাকতে পারে।
এই লেখকের সব লেখা পড়ুন নিচের লিংক থেকে।
www.royalbangla.com/dr.hasnahossain
লেখিকা
ডাঃ হাসনা হোসেন আখী
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য)
এমএস (অবস এন্ড গাইনী)
ট্রেইন্ড ইন ল্যাপারস্কপি এন্ড ইনফার্টিলিটি স্ত্রী রোগ ও প্রসূতি বিদ্যা বিশেষজ্ঞ এবং ল্যাপারস্কপিক সার্জন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
নিয়মিত রোগী দেখছেন: মার্কস কনসালটেশন সেন্টার।
প্রতিদিন : বিকেল ৫ টা হতে রাত ৮ টা পর্যন্ত।
সিরিয়াল : 01729-269437.
সিরাজ মার্কেট (২য় তলা), কচুক্ষেত, ঢাকা-১২০৬। (ফুট ওভার ব্রিজের পাশে)
লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে নিচের ফেসবুক পেইজে ক্লিক করুন
www.facebook.com/dr.hasnahossain