আধুনিক সমাজে রক্তপরিসঞ্চালন সহজেই বাঁচিয়ে দিচ্ছে অসংখ্য মানুষের জীবন। এককালে সাধারণ রক্তক্ষরণেই মারা যেত অসংখ্য মানুষ।
মানব দেহে সফল রক্ত পরিসঞ্চালনের ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়। তবে এর প্রচেষ্টাটি দীর্ঘ।
রক্তপরিসঞ্চালনের ইতিহাসঃ
১৫৪২ সালে পোপ অষ্টম ইনোসেন্ট তরুন হবার আশায় তিন তরুনের শরীর থেকে রক্ত নিলেন নিজের শরীরে।হতভাগ্য পোপ মারা গেলেন, তারুন্য ফিরে পাওয়া হলোনা। বলা যায় এটাই ছিল রক্ত পরিসঞ্চালণের প্রথম উল্লেখযোগ্য প্রয়াস।
১৬৬৭ সালে ফরাসী বিজ্ঞানী জাঁ ব্যাপটিস্ট মানুষের শরীরে ভেড়ার রক্ত ভরলেন। মানুষটি মারা গেল। জাঁ ব্যাপটিস্ট খুনের দায়ে অভিযুক্ত হলেন। এরপর অনেকবছর থেমে ছিল রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রচেষ্টা।
১৮১৮ সালে জেমস ব্লান্ডেল নামে এক ব্রিটিশ ডাক্তার তাঁর নিজের তৈরী ট্রান্সফিউশন সেট দিয়ে এক প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণের রোগীর শরীরে রক্ত পরিসঞ্চালন করলেন। রক্ত দিলেন রোগীর স্বামী। রোগীটি বেঁচে গেল । সেই উৎসাহে জেমস সাহেব আরো কয়েকজন রোগীকে একই ভাবে রক্ত দিলেন। কিন্তু এদের অনেকেই মারা গেল। মানুষের কাছে রক্ত পরিসঞ্চালনের আসল রহস্যটি তখনো পরিষ্কার হয়নি।
১৯০১ সাল । কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার নামের একজন অস্ট্রিয়ান চিকিৎসাবিজ্ঞানী জানালেন রক্তের প্রধান তিনটি গ্রুপের কথা। এ, বি,ও গ্রুপ। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের সাথে মেলেনা। গ্রুপ মিলিয়ে রক্ত দিলে তবেই পরিসঞ্চালন নিরাপদ হবে। ১৯৩০ সালে এই মহান বিজ্ঞানী নোবেল পান।
১৯৪০ সালে তিনি মানব জাতিকে এগিয়ে দিলেন আরেক ধাপ। বললেন রক্তের নেগেটিভ পজিটিভের কথা। এর নাম আর এইচ সিস্টেম।
রক্তদান ভাল নাকি মন্দঃ
রক্ত দেওয়া নিয়ে অনেকের মনে অনেক ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে। রক্ত দিলে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না। রক্ত দিলে শরীর শুকিয়ে যায়না, শক্তি নিঃশেষ হয়না৷ বরং রয়েছে নানা রকম উপকার। এতে একজন মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব।
গবেষণায় মিলেছে, নিয়মিত রক্ত দিলে বিশেষ কিছু ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। রক্ত দিলে শরীরে নতুন লোহিত কণিকা তৈরির হার বাড়ে। এতে অস্থিমজ্জার রক্ত উৎপাদন প্রক্রিয়া সক্রিয় থাকে।যাদের রক্তে আয়রনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে, তাদের জন্য রক্তদান এক ধরনের চিকিৎসা৷ রক্ত দিলে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে , কারো কারো ক্ষেত্রে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। শরীরে হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, জন্ডিস, ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, এইচআইভি বা এইডসের মতো বড় কোনো রোগ রয়েছে কি না, সেটি রক্তদান উপলক্ষে জানা হয়ে যায়। এগুলো বাড়তি সুবিধা।বাংলাদেশে প্রতিবছর ছয়লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। এর এক পঞ্চমাংশ আসে স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের কাছ থেকে৷ আশার কথা যে স্বেচ্ছায় রক্তদানের হার দিন দিন বাড়ছে।
তবে কারা রক্ত দিতে পারবেন আর কারা পারবেন না, এ নিয়ে কিছু নির্দেশনা রয়েছে। সেগুলো দেখে নেওয়া যাক।
কারা রক্ত দিতে পারেনঃ
১
১৮ থেকে ৬০ বছরের যেকোনো শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ রক্ত দান করতে পারবেন। (কোন কোন দেশের গাইড লাইনে ৭০ বছর পর্যন্তও অনুমোদন দেওয়া হয়।)
২
যাদের ওজন ৫০ কিলোগ্রাম কিংবা তার বেশি তারা রক্ত দিতে পারবেন। (কোন কোন ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৪৫ কেজি পর্যন্ত গণ্য করা হয়)
৩
কোনো ব্যক্তি একবার রক্ত দেওয়ার চার মাস পর আবার রক্ত দিতে পারেন।
কারা রক্ত দেবেন নাঃ
ক
রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম থাকলে (পুরুষের ন্যূনতম ১২ গ্রাম/ ডে.লি. নারীদের ১১ গ্রাম/ডে.লি.), রক্তচাপ ও শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক না থাকলে রক্ত দেওয়া উচিত নয়।
খ
শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ অ্যাজমা, হাঁপানি যাদের রয়েছে তারা রক্ত দিতে পারবেন না।
গ
রক্তবাহিত রোগ, যেমন—ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, গনোরিয়া, হেপাটাইটিস, এইডস, চর্মরোগ থাকলে রক্তদান করা যায় না।
ঘ
হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও বাতজ্বর থাকলে রক্ত দেওয়া যায়না
ঙ
নারীদের মধ্যে যারা গর্ভবতী এবং যাদের ঋতুস্রাব চলছে তারা রক্তদান করতে পারবেন না৷
চ
সন্তান জন্মদানের পরবর্তী এক বছর পর্যন্ত রক্তদান করা উচিত নয়।
ছ
যারা কোনো বিশেষ ধরনের ওষুধ ব্যবহার করছেন, যেমন- অ্যান্টিবায়োটিক, কেমোথেরাপি, হরমোনথেরাপি ইত্যাদি তারা রক্তদান করবেন না৷
জ
যাদের ছয় মাসের মধ্যে বড় কোনো অপারেশন বা বড় কোনো দুর্ঘটনা হয়েছে তারা রক্তদান করতে পারবেন না।
নিকটাত্মীয়র রক্ত- ভাল নাকি মন্দঃ
এটা সাধারণভাবে মনে করা হয় যে নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে রক্ত নিতে পারলে সেটাই বেশি ভাল। কারণ এতে রক্তের শুদ্ধতা, রক্তদাতার সুস্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এটা একধরণের প্রচলিত ধারণা। আসলে নিকটাত্মীয়দের থেকে রক্ত নিলে ট্রান্সফিউশন এসোসিয়েটেড গ্রাফট ভারসাস হোস্ট ডিজিজ (TA-GVHD) নামের একটি ভয়ংকর রোগের সম্ভাবনা থাকে। এই রোগ বিরল কিন্তু অত্যন্ত ভয়ংকর। মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত। নিকটাত্মীয় বলতে আপন ভাই, বোন, মাতা,পিতা বা পুত্র কন্যা যাদের মধ্যে HLA মিলে যাবার সম্ভাবনা বেশি৷ এতে করে শরীর দাতার T cell কে নিজের বলে ভেবে নেয়। যা পরে গ্রহীতার শরীরে বেড়ে ওঠে এবং গ্রহীতার কোষ কলাকেই ধ্বংস করতে থাকে৷
অহেতুক পরিসঞ্চালন নয়ঃ
রক্ত পরিসঞ্চালন হবে শুধুমাত্র জীবন রক্ষা করবার৷ নিছক হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর জন্য নয়৷ অপ্রয়োজনীয় পরিসঞ্চালন নানা রকম ঝুঁকি বাড়ায়। নানারকম জীবানু সংক্রমণ ছাড়াও আছে পরিসঞ্চালন জনিত কিছু জটিলতা৷ যা কোন কোন সময় মৃত্যুর কারণও হতে পারে। রক্ত দেওয়ার আগে কেন রক্ত দিচ্ছেন সেটা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। বলা হয় হিমোগ্লোবিন ৭ গ্রাম/ডে. লি. এর নিচে না নামলে সাধারণত রক্ত দিতে হয়না। অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে এই নির্দেশনার উনিশ বিশ হতে পারে। কিন্তু মূল কথা ওটাই -শরীরে রক্ত নেবার আগে অন্তত দশবার ভাবুন।
লেখক
ডাঃ গুলজার হোসেন
বিশেষজ্ঞ হেমাটোলজিস্ট
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল
চেম্বারঃ
বি আর বি হাসপাতাল পান্থপথ, ঢাকা।
www.facebook.com/gulzarhematologist