আমাদের সকলেরই কমবেশি মাথা ব্যথা হয়ে থাকে। অনেক সময় কাজের চাপে বা অতিরিক্ত ঠান্ডা অথবা অতিরিক্ত গরম বা অনেক কারণের জন্য মাথা ব্যথা হয়ে থাকে। জীবনে মাথাব্যথা হয়নি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া খুবই দুর্লভ। এক কথায় যাকে বলে অসম্ভব।
মাথাব্যাথার এই অন্যতম কারণ হচ্ছে মাইগ্রেন। কোন একটি জরিপে দেখা গেছে, প্রতি ৪ জন মহিলার মধ্যে ১ জন এবং প্রতি ১২ জন পুরুষের মধ্যে একজন পুরুষ কোন না কোন সময় মাইগ্রেনের সমস্যায় আক্রান্ত হন।
মাইগ্রেন একটি অসহনীয় অসুখের নাম। মাইগ্রেনের সমস্যা হলে আমরা অনেকেই নিজে থেকে বিভিন্ন ওষুধ, ক্যাফেইন, সরাসরি পুষ্টি গ্রহণসহ নানা কাজ করে থাকি। কিন্তু আমরা হয়তো অনেকেই জানি না যে, এগুলো মাইগ্রেনের তেমন কোনো উপকারে আসে না। আবার অনেকেই মনে করে থাকেন এটি কোন গুরুতর সমস্যা নয়। এছাড়াও আরো কিছু প্রচলিত ধারণা রয়েছে যেমন - এটি একটি সাধারণ মাথাব্যথা, সাপ্লিমেন্ট মাইগ্রেন নিরাময় করে থাকে ইত্যাদি।
তবে এই মাইগ্রেন কি? আসুন একটু জেনে নেই এই সম্পর্কে -
ধারণা করা হয়, মাইগ্রেন এক ধরনের নিউরোভাসকুলার ডিসঅর্ডার। কারণ এই সমস্যা মস্তিষ্কে সৃষ্টি হয় তারপর ধীরে ধীরে রক্তশিরায় ছড়িয়ে যায়। তবে কিছু কিছু গবেষক মনে করেন, নিউরোনাল বিষয়গুলো অধিকতর এ ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে কয়েকজন মনে করেন, রক্তশিরাই মূল প্রভাব ফেলে। আবার অনেকেই মনে করেন এই দু-ই বেশ গুরুত্বপূর্ণ
মাইগ্রেন শব্দের উৎপত্তি হচ্ছে গ্রীক শব্দ 'হেমিক্রোনিয়া ' থেকে যার অর্থ হল মাথার একদিকে ব্যথা। 'হেমি'শব্দের অর্থ হল অর্ধেক এবং 'ক্রনিয়ন ]' শব্দের অর্থ হচ্ছে খুলি থেকে সৃষ্টি।
মাইগ্রেন হচ্ছে একটি মাথাব্যথার ধরন। আক্রান্ত ব্যক্তির মাথার একপাশে তীব্র মাথাব্যথা হয়ে থাকে।এ সময় বমি, আলো ও আওয়াজ এ সংবেদনশীলতা দেখা যায়।এই ব্যথা কয় ঘন্টা থেকে শুরু করে কয়েক দিন পর্যন্ত হতে পারে।
মাইগ্রেনের ধরন -
মাইগ্রেন বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তবে সবারই 'সাধারণ মাইগ্রেন 'থাকে না। মাইক জেনে কিছু কিছু ধরণের নির্দেশিকা নিচে দেয়া হল -
1.আভাসহ মাইগ্রেন
2.আভা ছাড়া মাইগ্রেন
3.দীর্ঘস্থায়ী মাইগ্রেন
4.ব্রেনস্টেম আভাসহ মাইগ্রেন
5.ভেস্টিবুলার মাইগ্রেন
6.হেমিপ্লেজিক মাইগ্রেন
7.চক্রিও বমি সিনড্রম
8.ওষুধের অতিরিক্ত ব্যবহার
9.অন্যান্য মাথাব্যথা ব্যাধি
মাইগ্রেনের কারণ -
- দীর্ঘ সময় উপোস করে থাকা
- স্ট্রেস
- ঘুমের সমস্যা
- মেনস্ট্রুয়েশন।
- ওরাল কন্ট্রাসেপটিভ পিল ব্যবহার করা।
- অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস।
- হরমোন জনিত সমস্যা।
- মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক কার্যক্রম
- পরিবেশগত সমস্যা ইত্যাদি।
- অনেক সময় আ্যালার্জিটিক কারনেও মাইগ্রেন দেখা যেতে পারে।
মাইগ্রেনের লক্ষণ -
- এর প্রধান লক্ষণ হচ্ছে যে কোন একপাশে মাঝারি থেকে তীব্র ধরনের ব্যাথা।
- বমি বমি ভাব।
- মনোযোগহীনতা।
- অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা অনুভূত হওয়া।
ডায়েটের সাথে মাইগ্রেনের সম্পর্ক -
আজকাল মানুষ শারীরিক সুস্থতা নিয়ে অনেক সচেতন।তাই সবাই কমবেশি একটা ভালো খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করতে চেষ্টা করেন। বর্তমানে অনেক ধরনের খাদ্যাভ্যাস লক্ষ্য করা যায়। এদের মধ্যে কিটো ডায়েট অন্যতম ।
বিশেষজ্ঞদের মতে , কিটো ডায়েটে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কম আর ফ্যাটের পরিমাণ বেশি থাকে। এই ফ্যাট থেকে পাওয়া এনার্জি মাইগ্রেনের ঘন ঘন ব্যথা হওয়ার প্রবণতা কমায়। তবে এই ডায়েট শুরু করার আগের অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
আবার অনেকে সাধারণ খাদ্যাভ্যাসও অনুসরণ করে থাকেন। তবে সেইসব খাদ্যাভাসে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় নিয়ম করে টাটকা শাকসবজি ফলমূল, ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম যুক্ত খাবার সমূহ, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স রেখে থাকেন।কিন্তু অ্যামাইনো অ্যাসিড টাইরামিনযুক্ত খাবারগুলো খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে।
মাইগ্রেন হলে কোন ধরনের খাবার গ্রহণ করা উচিত -
প্রথমেই আসি খাবারের কথায়। মাইগ্রেনের জন্য আমরা যে ধরনের খাবার গ্রহণ করতে পারি -
ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার: দুধ, দই, বিনস, ব্রকলি, তিসি, তিল, কমলালেবু, পেঁপে, পোস্তদানা, ব, টফু, পালং শাক, ঢ্যাঁড়স, কাঁটাসহ সব ধরনের ছোট মাছ, রুই, বাটা, ফলি, কাতলা, শিং, কাঁকড়া, মাগুর, সরপুঁটি ইত্যাদি।
ম্যাগনেশিয়ামসমৃদ্ধ খাবার: সবুজ শাকসবজি, বিনস, ব্রকলি, নাটস, তিল, কলা, সি ফুড, চিনাবাদাম, ও ঢেঁকিছাঁটা চাল, ভুট্টা, চিড়া, আটা, মুগডাল, মাষকলাইয়ের ডাল, ছোলার ডাল, পেঁয়াজকলি, মুলা, গুঁড়া দুধ, বরবটি, কাজুবাদাম, নারকেল, পাকা আম, জিরা, আদা ইত্যাদি।
ভিটামিন বি২, ভিটামিন বি৬,ভিটামিন বি৩ সমৃদ্ধ খাবার: দুধ, টুনা মাছ, ব্রকলি, কাঠবাদাম, ডিম, মাশরুম,চীনবাদাম, আখরোট, কাঠবাদাম, তিল, সূর্যমুখীর বীজ, ডাবলি বুট, সবুজ মুগডাল, আপেল, খেজুর, আম, ডুমুর, কলা, ডিম, টুনা মাছ, মুরগির মাংস,শজনেপাতাইত্যাদি।
মাইগ্রেনের জন্য যেসব পানীয় পান করা উচিত -
পানি বেশি বেশি পানি পান করলে মাইগ্রেনের আশঙ্কা কমে। তবে শরীর হাইড্রেটেড রাখতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ভেষজ চা শরীর হাইড্রেটেড রাখতে ভেষজ চা হতে পারে অন্যতম উপকারী পানীয়।
তরমুজ তরমুজের মতো ফলে ৯২ শতাংশ পানি থাকে। এটা খেলে পানি স্বল্পতা কমে, খিদে কমে এবং মাইগ্রেনের আশঙ্কা কমে যায়।
এছাড়াও বিভিন্ন ফলের জুস প্রতিনিয়ত পান করা যায়। খাদ্য তালিকায় নিয়মিত লেবু পানিও রাখা যেতে পারে।
কিন্তু মাইগ্রেনের সমস্যা দেখা দিলে জাঙ্ক ফুড, প্রসেসড ফুড , বাজারের খোলা খাবার, উচ্চ মসলাযুক্ত খাবার, অ্যালকোহল , ধূমপান বাদ দিয়ে চলা উচিত।
মাইগ্রেন আক্রমণে কেমন অনুভূতি হয়?
মাইগ্রেনে সাধারণত মাথার একপাশে প্রচণ্ড কেঁপে কেঁপে ব্যথা বা অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। মাইগ্রেন হলে প্রায়শই বমি বমি ভাব বা বমি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং এটি আলো, শব্দ, ও তীব্র গন্ধের প্রতি চরম সংবেদনশীল হয়। মাইগ্রেনের আক্রমণ কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিন স্থায়ী হতে পারে এবং ব্যথা এতটাই খারাপ হতে পারে যে এটি দৈনন্দিন কাজকর্মকে মারাত্নকভাবে ব্যহত করে।কখনও কখনও যন্ত্রণার তীব্রতা এমন আকার ধারণ করে যে, কাজ তো দূর, শুয়েও আরাম পাওয়া যায় না। মাইগ্রেনের ব্যথা বুঝে ওঠার আগেই ব্যথা অনেকটা দূর পৌঁছে যায়।
নিউরোলজিস্টরা মনে করেন, অগোছালো জীবনযাত্রা ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এর জন্য দায়ী।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পুরুষদের তুলনায় নারীদের মাইগ্রেনের সমস্যা বেশি দেখা যায়। হরমোনের তারতম্যই এর মূল কারণ।এ ছাড়া নারীদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের কারণে অনেক নারীই মাইগ্রেন সমস্যায় আক্রান্ত হন।
অনেক মেয়ের বয়ঃসন্ধিক্ষণে প্রথম পিরিয়ডের সময় মাইগ্রেনের সমস্যাও শুরু হতে পারে আবার মেনোপজের পরে এই সমস্যা দূর হয়ে যায়। যে নারীরা ওরাল কনট্রাসেপটিভ পিল খান তাদের ক্ষেত্রেও মাইগ্রেনের সমস্যা বেশি দেখা যায়।
কোন খাবারে মাইগ্রেন তাড়াতাড়ি কমে -
- কলা
- তরমুজ
- মাশরুম
- রঙিন শাকসবজি ফলমূল
- বাদাম বীজ
- ভেষজ চা
- ডার্ক চকলেট
- লবঙ্গ
মাইগ্রেনের চিকিৎসা -
1.প্রতিদিন সময়মতো ঘুমাতে হবে।
2.প্রতিদিন অন্তত ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুম হতে হবে।
3.অতিরিক্ত বেশি আলো বা অতিরিক্ত কম আলোতে কাজ করা যাবে না।
4.মোবাইল, কম্পিউটার ল্যাপটপ, টিভি দীর্ঘ সময় ধরে দেখা যাবে না।
5.তীব্র ঠান্ডায় অথবা অতিরিক্ত রোদে বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
6.প্রচুর পানি পান করতে হবে।
7.মাথায় ঠান্ডা কাপড় জড়িয়ে রাখা যেতে পারে
8.শ্বাসের ব্যায়াম করা যেতে পারে।
9.অনিয়মিত জীবনযাপন পরিহার করতে হবে।
10.ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ করতে হবে।
মাইগ্রেন একটি মানুষের সাধারণ জীবন ধারাকে ব্যাহত করে। মাথাব্যথার তীব্রতা বেড়ে গেলে কারো কারো ক্ষেত্রে এটি মোকাবিলা করা অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে যায়।তবে সঠিক চিকিৎসা এবং নিয়মিত জীবন যাপনের ফলে এই সমস্যা সহজেই নিরাময় পাওয়া যায়। তাই অবহেলা না করে মাথাব্যথা কে গুরুত্ব দিয়ে সঠিক চিকিৎসা নিয়ে আমাদেরকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হবে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখিকা
ইন্দিরা রায়
ফুড এন্ড নিউট্রিশন নিয়ে অধ্যয়নরত